উত্তর : মুঘল - আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । বস্তুত মুঘল - আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিনটি পর্যায় । প্রথম পর্যায় শুরু হয় পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ ও ইব্রাহিম লােদীর পিতৃব্য আলম খান বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানায় এবং শেষ
হয় পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ও ঘর্ঘরার আফগানদের পরাজয় । দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হুমায়নের সিংহাসন আরােহন থেকে ( ১৫৩০ ) শেষ হয় কনৌজের যুদ্ধ ( ১৫৪০ ) শেরশাহের হাতে হুমায়নের পরাজয় । এরপর ১৫ বছরের ( ১৫৪০ - ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ ) বিরতি । এই সময় শেরশাহ , তার পুত্র ও আত্মীয়রা সিংহাসন দখল করেছিলেন । তৃতীয় ও শেষ পর্যায় আরম্ভ হয় হুমায়ুন কর্তৃক সিংহাসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা থেকে শেষ হয় পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খাঁর হাতে হিমুর পরাজয় ও মৃত্যুতে ( ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে )।
ষােড়শ শতকের শুরুতে লােদী বংশের সবচেয়ে সফল সুলতান সিকান্দার শাহ ( ১৪৮৯ - ১৫১৭ খ্রিঃ ) এর পুত্র ইব্রাহিম লােদী সিংহাসনে বসলে আফগান স্বাতন্ত্র্যবােধ মাথা চারা দিয়ে ওঠে । রাজ্যের প্রভাবশালী আফগান নেতারা , বিহারে জায়গীরদার শের খান শুর এবং পাঞ্জাব শাসনকর্তা দৌলত খাঁ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । কাবুল থেকে বাবর ভারতবর্ষের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন । বাবর মনে করতেন , তৈমুর লঙ এর উত্তরাধিকারী হিসাবে ভারতের উপর তার অধিকার আছে । বাবরের সামনে সুবর্ণ সুযােগ এল যখন পাঞ্জাব শাসনকর্তা দৌলত খাঁ এবং আলম বাবরকে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহ্বান জানায় । সম্ভবত রানা সিংহ বাবরকেও ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান ।
কুরুক্ষেত্রের কাছে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় ( ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে )। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লােদীর পক্ষে ছিল ১ লক্ষ সৈন্য এবং সহস্রাধিক হস্তি । অন্যদিকে বাবর এনেছিলেন ১২০০০ অশ্বারােহী এবং গােলন্দাজ বাহিনী । রুমী প্রথায় বাবর যুদ্ধ করেন । এই প্রথায় সামনাসামনি যুদ্ধ না করে মুঘল সৈন্য এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে আফগানদের ঘিরে ফেলে । পরে গােলন্দাজ বাহিনী সামনে থেকে আক্রমণ চালায় এবং আফগানরা ছত্রভঙ্গ হয় । বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন । ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানােয়ার প্রান্তরে রাজপুতরা পরাজিত হয় ।স্থাপিত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ।
বিহারে ইব্রাহিম লােদীর ভাই মহম্মদ লােদীর নেতৃত্বে আফগানরা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয় । বাংলার শাসনকর্তা নসরৎ শাহ (খাঁ ) এদের সাহায্যে এগিয়ে আসে । পাটনার উত্তরে ঘাগড়া বা ঘর্ঘরায় ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘলবাহিনী আফগানদের পরাজিত করে । এইভাবে পানিপথ, খানােয়ার , চান্দেরী এবং ঘর্ঘরার যুদ্ধে বাহিনীদের সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে আফগানদের অবসান ঘটান । কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে , মুঘল সাম্রাজ্যের মূল তখনও সুদৃঢ় হয়নি । এই কাজে হাত দেবার পূর্বেই বাববের মৃত্যু ঘটে( ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ) ।
তথাপি আফগানরা লােদী সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতাে । ঘর্ঘরার যুদ্ধের পর বিক্ষুব্ধ আফগানরা বিহারে সর্দার শের খানের নেতৃত্ব লাভ করে । হুমায়ন চুনার দুর্গ অবরােধ অসমাপ্ত রেখে আগ্রা ফিরে গেলে ( ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ )শের খান চুনার দখল করেন । হুমায়ন পুনরায় চুনার জয় করে গেীড়ে ফিরে যান এবং গৌড় জয় করে আগ্রায় ফিরবার পথে বক্সারের কাছে চৌসায় শেরশাহের সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হয়ে পড়েন এবং পরাজিত হন । হুমায়ন কোনভাবে পালিয়ে যান কিন্তু শের খান ছাড়বার পাত্র ছিলেন না । কনৌজের বিল্লগ্রামের যুদ্ধে আবার ( ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ ) হুমায়ন পরাজিত হন । হুমায়ন সিন্ধু প্রদেশে পালিয়ে যান এবং শের শাহ সিংহাসন দখল করেন এবং মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় ।
১৫৪০ - ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দ : এই সময়টুকুর মধ্যে হুমায়ন কাবুলে শক্তি সঞ্চয় করতে সমর্থ হন এবং ভারতে শূরদের প্রতি নজর দেন । ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে লাহােরে সিকান্দার শূরকে আক্রমণ করেন এবং মুঘল আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতার তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় । লাহােরে জয়লাভ করে মুঘল সৈন্য এগিয়ে গিয়ে সির হিন্দে আফগান বাহিনীকে পরাজিত করে । হুমায়ন দিল্লি, আগ্রা পুনরুদ্ধার করেন কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই হুমায়ন মারা যান । ( জানুয়ারি , ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ) হুমায়নের নাবালক পুত্র আকবরকে তখন লাহােরে বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে বাদশাহ ঘােষণা করা হয় । দিল্লির শাসনকর্তা তখন মুঘল প্রতিনিধি তারদি বেগ । আদিল শূরের নেতৃত্বে হিন্দু প্রতিনিধি হিমু তারদি বেগকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করে নেন এবং নিজেকে দিল্লির শাসনকর্তা বলে ঘােষণা করেন । পাঞ্জাব থেকে বৈরাম খাঁ দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে ( ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ) হিমুকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ।