বাহমনী রাজ্যের বিস্তারে মামুদ গাওয়ানের ভূমিকা লেখাে ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর বাহমনী রাজ্যের বিস্তারে মামুদ গাওয়ানের ভূমিকা লেখাে bahomoni rajyar bistare mamud gaoyaner bhumika lekho


উত্তর : ১৪৬১ সালে বাহমনী শাসক হুমায়নের মৃত্যু হলে মাত্র নয় -দশ বৎসর বয়সে তৃতীয় আহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন । নাবালক রাজার প্রতিনিধি হয়ে শাসনকার্য চালাবার জন্য তিনজন সদস্যের একটি ‘ অভিভাবক মণ্ডলী’ বা ‘ Regency Council ’ গঠিত হয় । এই মণ্ডলীতে ছিলেন সুলতানের মাতা মাকদুমা - ই- জাহান নার্গিস বেগম ,খাজা - ই - জাহান এবং মামুদ গাওয়ান । ১৪৬৩ সালে আহম্মদ শাহ মারা গেলে তার ভাই মহম্মদ শাহ রাজত্ব চালনা শুরু করেন । অল্প কিছুকালের মধ্যে খাজা - ই - জাহান প্রকাশ্য দরবারে নিহিত হলে মামুদ গাওয়ানকে ‘ভাকীল - উস্ - সুলতানৎ’ অর্থাৎ “রাজ্যের প্রধান সহকারী” বা প্রধান মন্ত্রীর পদে উন্নীত করা হয় এবং ১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দ , তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন । তার আমলে বাহমনী সাম্রাজ্য উন্নতি ও খ্যাতির চরম শিখরে আরােহণ করে । 



মামুদের অভিযান : ১৪৬৯ সালে কোঙ্কনের রাজাদের দমনের উদ্দেশ্যে মামুদ গাওয়ান অভিযান পরিচালনা করেন । তিনি কয়েকটি দুর্গ দখল করেন এবং সঙ্গমেশ্বরের রাজাকে খেলনা দুর্গ স্থাপন করতে বাধ্য করেন । মামুদ গাওয়ানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব হল গােয়া দখল । গােয়া ছিল সেই সময়ের খুবই উন্নত বন্দর । যেহেতু বাহমনীরা দীর্ঘদিন ধরে গােয়ার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল । ১৪৭১ সালে সর্বাপেক্ষা সকল অভিযান প্রেরিত হয় কাঞ্চির রাজার বিরুদ্ধে । এই অভিযান থেকে বাহমনীরা বিশাল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য সংগ্রহ করেন । সুলতান মহম্মদ শাহ নিজেও এই সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং তার কৃতিত্বের নিদর্শন হিসাবে ‘লস্করী’ উপাধি গ্রহণ করেন । এই সময়ে মাকদুমা - ই - জাহানের মৃত্যু হয় । ১৪৭৪ সালে অনাবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটায় দেশ এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়, তথাপি সামরিক অভিযান চলতে থাকে এবং উড়িষ্যার রাজাকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয় । 

শাসন ব্যবস্থা : মামুদ গাওয়ান ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক , প্রাদেশিক শাসকদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে রাজ্যকে তিনি দশটি ‘তরফ ’ বা ‘বিভাগে’ বিভক্ত করেন । প্রত্যেকটি তরফকে আবার দুটি করে ভাগ করেন । তাদেরকে ‘সারলস্করসিপ’ বা উপবিভাগ বলা হয় । তার শাসন সংক্রান্ত কড়াকড়ির ফলে তরফদার এবং সেই সঙ্গে ‘দক্ষিণী’রা  গাওয়ানের বিরুদ্ধে রুষ্ট হয় । প্রত্যেকটি প্রদেশের ‘কিলাদার’ বা দুর্গ রক্ষকদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনাহয় এবং জায়গীরদারদের তাদের জায়গীর থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় ও সুলতানের নিকট 




তাদের কাজের জন্য দায়িত্বশীল করা হয় । মামুদ গাওয়ান রাজ্যের অর্থ ব্যবস্থারও সংস্কার করেন । দক্ষিণী ( স্বদেশী ) এবং আকাকী ( পারদর্শী ) দের মধ্যে দলাদলি দূরীভূত করার জন্য প্রদেশ সমূহে সমসংখ্যক দক্ষিণী ও আকাকী প্রশাসক নিযুক্ত করেন । তিনি নিজে বিজাপুরের শাসনভার গ্রহণ করেন । বুরহানের মতে “মন্ত্রী হিসাবে গাওয়ান ছিলেন অদ্বিতীয় ।”



সাহিত্য ও শিল্প : মামুদ গাওয়ান ছিলেন সাহিত্য ও শিল্পের বড় পৃষ্ঠপােষক । তিনি জনগণের শিক্ষার দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেন । রাজধানী বিদরে এই উদ্দেশ্যে একটি বড় মাদ্রাসা নির্মাণ করেন । মামুদ গাওয়ানের প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ার কয়েকজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এই মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন । ১৯৭০ সালে রুশদেশীয় বণিক আথানসিয়াস নিকিতন বাহমনী রাজ্য পরিদর্শনকালে রাজধানী বিদরকে  ‘সমগ্র হিন্দুস্থানে মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন । 


কিন্তু গাওয়ানের এই প্রশাসনিক সংস্কার এবং জনপ্রিয়তা দক্ষিণী অভিজাতদের ঈর্ষান্বিত করে তােলে এবং ভারতের ইতিহাসের এক মহান রাজনীতিবিদকে ‘হত্যার হীন ষড়যন্ত্র’ রচিত হয় । তার বিরুদ্ধে অভিযােগ করা হয় যে , গাওয়ান উড়িষ্যার রাজার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাহনী রাজ্য দখলের অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন । এক জাল চিঠিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয় । এই ষড়যন্ত্রে ভুল করে সুলতান মহম্মদ শাহ ১৪৮১ সালের ৫ ই এপ্রিল মামুদ গাওয়ানকে প্রাণদণ্ড দেন । এ সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে রােমিলা থাপার বলেন – “আভ্যন্তরীন সংকটের ফলে বাহমনী রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং এই সংকট মােচন করতে গিয়ে মামুদ গাওয়ান নিজেই এর বলি হন ।”


রাষ্ট্রের প্রতি নিবেদিত এই মানুষটির হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে বাহমানী সাম্রাজ্যের গৌরব সূর্য অস্তমিত হয় । ঐতিহাসিক মিডােজ টেইলর মন্তব্য করেছেন  ‘তার হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে বাহমনী রাজ্যের সংহতি ও ক্ষমতা অন্তর্হিত হয়।’ ডঃ সতীশ চন্দ্র বলেছেন - “গাওয়ানের মৃত্যুর পর দলবিরােধ আরও তীব্র আকার ধারণ করে ।” এই সুযােগে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ স্বাধীন হয়ে উঠলেন । শীঘ্রই বাহমনী রাজ্য পাঁচটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল । সেগুলি হল গােলকুণ্ডা, বিজাপুর , আহম্মদনগর , বেরার ও বিদর । এই রাজ্যগুলির মধ্যে আহম্মদনগর , বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা খ্রিস্টীয় সতেরাে শতকে মুঘন্ড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্তি পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে । 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন