ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান নির্ণয় কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান নির্ণয় কর bharoter itihase ashoker sthan nirnay koro questions answers


উত্তর : ( ১) ভূমিকা — সম্রাট অশােকের দীর্ঘ ৩৭ বছরের শাসনকাল ( ২৭৩ – ২৩৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ) ভারতের ইতিহাসের ‘একটি বিরল এবং উজ্জ্বল অধ্যায়’ হিসাবে চিহ্নিত । এই যুগেও ঔজ্জল্য তখনও বিলীন হয়নি । তার রাজসিক আদর্শ ইতিহাসের দীর্ঘপথ অতিক্রম করেও এখনও অম্লান হয়ে আছে । H.G. Wells অশােকের কৃতিত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন মানুষ ও সুশাসক হিসাবে অশােক পৃথিবীর সর্বকালের রাজাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে আছেন । তিনি আরও লিখেছেন “ সহস্র , সহস্র নৃপতি যাঁরা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ভিড় করে আছেন তাদের মধ্যে একমাত্র অশােকের নামই উজ্জ্বল তারকার মতাে শােভা পায় । 


( ২ ) অশােকের কার্যাবলী — বৌদ্ধ সাহিত্যে দেখা যায় যে প্রথম জীবনে অশােক ছিলেন রক্ত পিপাসু ও নিষ্ঠুর । তিনি তার ভ্রাতাদের হত্যা করে সিংহাসনে আরােহণ করেন । বৌদ্ধসূত্রে তাকে চণ্ডাশােক বলে অভিহিত করা হয়েছে । পরবর্তী জীবনে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে ধর্মাশােকে পরিণত হন । আসলে কিংবদন্তীর চণ্ডাশােক সত্য নাও হতে পারেন , ইতিহাসের ধর্মাশােক জীবন্ত চরিত্র । 
 

সমরকুশলী ও রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি তার যােগ্যতার অনেক প্রমাণ দিয়েছেন । ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অশােক সম্পর্কে বলেন ।  অশােকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উৎসাহ  , সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভা এবং আকবরের ঔদার্য । অশােকের চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ছিল যুদ্ধ বিজয়ীর দক্ষতা এবং শান্তির স্থপতিকারের মহিমা । কলিঙ্গের মতাে শক্তিশালী দেশকে তিনি এক বছরের মধ্যে পদানত করেছিলেন । কলিঙ্গের মিত্র হিসাবে চোল ও পাণ্ড্যগণও এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল ।

 
মৌর্যবাহিনী তাদের ধ্বংস করে সাম্রাজ্যের সংহতি বৃদ্ধি করেছিল । কলিঙ্গ যুদ্ধ জয়লাভ তার পরবর্তীকালের ঘটনা অশােকের বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে । রােমিলা থাপারের মতে যদিও অশােকের কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য রক্ত ও লৌহনীতির ওপর দাঁড়িয়েছিল তথাপি তিনি তাকে গভীর সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ করে সাম্রাজ্যের সংহতি দৃঢ় করে তােলেন । অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তিনি যদি কলিঙ্গ যুদ্ধের পরও রাজ্যজয়ের নীতি চাপিয়ে যেতেন তাহলে তার মত অপরসীম দক্ষ শাসক খুব সহজেই দক্ষিণ ভারত জয় করতে পারতেন এবং ভারতের বাইরেও সামরিক অভিযান চালিয়ে বহুদেশ অধিকার করে মহাবীর আলেকজাণ্ডারের ন্যায় যােদ্ধা হিসাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান পেতে সমর্থ হতেন । কিন্তু অশােক তাঁর চরমতম সামরিক গৌরবের সময় হিংসানীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয়ে লিপ্ত এবং প্রেম ও মৈত্রীর দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার জন্য সৃষ্টিধর্মী পরিকল্পনা করেন । তার ত্যাগ ও তিতিক্ষা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে । এই কারণে তার রাজত্বকাল প্রপীড়িত মানব ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল বিরতিকাল বলে গণ্য হয় । 
 

( ৩ ) শাসননীতি — অশােক শাসক ও সংগঠক হিসাবেও অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । চন্দ্রগুপ্ত যে শাসন ব্যবস্থা গঠন করেন তার মূল নীতিকে অক্ষুন্ন রেখে তিনি তার সংস্কারগুলাে কার্যকরী করেন । তার শাসনতন্ত্রের সংস্কার প্রজাবর্গের সুখ - সুবিধার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল । প্রজাদের পার্থিব উন্নতির জন্য অশােক নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করেন । রাস্তার পাশে কূপ খনন , বৃক্ষ রােপন , সরাইখানা স্থাপন মানুষ ও পশুর চিকিৎসার জন্য পৃথক পৃথক দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করে ছিলেন । তিনি প্রজাবর্গকে নিজের সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতেন ।তিনি ঘােষণা করেছিলেন , ‘সব মুনিষে পজা মমা’ । অর্থাৎ সবমানুষই আমার সন্তান । তিনি তাঁর প্রজাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ - সাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হননি । তাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন । “ সব মুনিষে পজা মম ” — অশােকের এই উক্তি রাজারকর্তব্যের ক্ষেত্রে এক নতুন ও মহান আদর্শ স্থাপন করেছিল সন্দেহ নেই । পৃথিবীর অপর কোন রাজা এরূপ আদর্শ পালন করে চলা তাে দূরের কথা এরূপ আদর্শ কল্পনাও করেন নি । অষ্টাদশ শতাব্দী ইয়ােরােপের ইতিহাসে প্রজাহিতৈষী স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব দেখতে পাই কিন্তু আজ আড়াই হাজার বছর পূর্বেই ভারতে সম্রাট অশােক প্রজাহিতৈষণার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন । বস্তুত পক্ষে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর দিগ্বিজয়ী সাম্রাজ্য লােলুপ অশােকের তিরােধান হয় এবং আবির্ভাব ঘটে রাজর্ষি অশােকের । 

 
( ৪ ) অশােকের কৃতিত্ত্ব— অশােক কেবল মানবজাতির ঐহিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধন করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না । সমস্ত প্রাণীগজতের মঙ্গল সাধনের মহান ব্রত এবং প্রজাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতির জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন । এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রজাদের সবসময় ধর্মসমাজ , ধর্মযাত্রা । ধর্মমঙ্গল, ধর্মবিজয় প্রভৃতিকে উৎসাহিত করতেন । তিনি বিহার যাত্রী দিগ্বিজয় প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন । জনসাধারণের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তিনি ধর্মমহামাত্র নামে একশ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত করেন । বিভিন্ন শ্রেণীর লােকদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বভাব প্রভৃতি মানবিক মূলনীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে ছিলেন । জাতীয় জীবনের প্রতি স্তরে পরস্পরের সহিষ্ণুতা অহিংসা  ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন । তিনি মানবতা ও অহিংসার আদর্শ কেবলমাত্র স্বদেশেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি । তাঁর এই বাণী অশােক  সাম্রাজ্যের বাইরে সুদূর প্রত্যন্ত অঞ্চল ছড়িয়ে দিয়েছেন । ভারতের বাইরে গ্রীস , মিশর , সিরিয়া , সিংহল , ব্ৰহ্বদেশ প্রভৃতি স্থানে সাম্য , মৈত্রী ও অহিংসার বাণী তিনি প্রচার করেছিলেন । বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ সহ - অবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন । ডক্টর রায়চৌধুরীর মতে অশােকের অনুসৃত অহিংস নীতি দুর্বল বা ক্লীবের অহিংসা ছিল না । যদিও কোন কোন ঐতিহাসিক আবার অশােকের অহিংস নীতি মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের কারণ বলে উল্লেখ করেন কিন্তু ডি.ডি. কেশােম্বী ও রােমিলা থাপার এই মতের বিরােধিতা করেছেন । তারা উল্লেখ করেন যে সাম্রাজ্যের সংহতি বৃদ্ধির জন্য অশােক অহিংসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন , সাম্রাজ্যের ক্ষতি করতে নয় । তাঁর অহিংসানীতি ও প্রজাকল্যানমূলক কাজ সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক দৃঢ় করেছিল । তারা আরও উল্লেখ করেন যে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করার পর অশােক যুদ্ধনীতির আর কোন প্রয়ােজন দেখেন নি । ব্যয়বহুল যুদ্ধের চেয়ে প্রজা কল্যাণে অর্থব্যয়কে তিনি অনেক বেশি মহৎকাজ বলে মনে করতেন । সংক্ষেপে বলা যায় যে অশােকের অন্যতম প্রধান কৃতিত্বই হল যে তিনি অহিংসার মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতাকে দৃঢ় করে তােলার চেষ্টা করেন । অপরদিকে তার তৈরি স্তম্ভ, স্তম্ভের অলঙ্কার ,সারনাথের সিংহমূর্তি অশােকচক্র , শিলালিপি , স্তুপ,বিহারগুলাে ভারতীয় শিল্প ও স্থাপত্যের অসাধারণ অগ্রগতি ঘটায় । সর্বশেষে উল্লেখ করা যায় যে বৌদ্ধধর্ম এতদিন পর্যন্ত ভারতবর্ষের চতুঃসীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল অশােকের প্রচেষ্টায়সেই ধর্মবিশ্বজনীন ধর্মে পরিণত হয় । 

 
( ৫ ) উপসংহার — উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিকগণ অশােককে পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত সম্রাটদের সঙ্গে তুলনা করেছেন । রােমের সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন যেরূপ খ্রিস্ট ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছিলেন । সম্রাট অশােকও তেমন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছিলেন । কনস্ট্যানটাইনের খ্রিস্টান ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত ছিল । কিন্তু অশােক রাজনৈতিক বা কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেন নি । জনকল্যাণই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য ।খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কনস্টান্টাইন অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন অশােকের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্যের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্ম প্রচার লাভ করেছিল । Holy Roman Empire বা পবিত্র রােমসাম্রাজ্যের সম্রাট শার্লমেনের সাম্রাজ্যের বিশালতা অশােকের সাম্রাজ্যের বিশালতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে । ব্যক্তিগতভাবে শার্লামেন ধার্মিক হলেও অপরাপর ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন নির্মম অত্যাচারী ।  শার্লামেনের মতাে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করার প্রথা অশােকের নীতি -বিরুদ্ধ ছিল । ভারতীয় রাজাদের মধ্যে সন্দেহাতীত ভাবে অশােক ও আকবরের নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য । উভয়েই সুশাসক এবং পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন । বৌদ্ধধর্ম প্রচারে অশােক সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করলেও আকবর দীন -ই -ইলাহী নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে গিয়ে অকৃতকার্য হন । উভয়েই ভারত ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । কিন্তু জনকল্যাণের আদর্শ ও অন্যান্য কার্যাদির দিক থেকে বিচার করলে অশােককেই ভারতের এমনকি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে স্বীকার করতে হয়, পল ম্যাসন আরসােল বলেন , মৌর্যবংশের তৃতীয় সম্রাট কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই শ্রেষ্ঠ নরপতি নন , তিনি পৃথিবীর দার্শনিক নৃপতিদের অন্যতম । 


 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন