উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে অথবা তারও পূর্ববর্তীকালে ভারতে কোন প্রকার রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না । প্রাচীন বৌদ্ধ রচনা অঙ্গত্তরনিকায় থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠশতাব্দীতে প্রধানত উত্তরভারতে ষােলটি মহাজনপদ বা বৃহদায়তন রাজ্যের উত্থান হয় । এই ষোললটি মহাজনপদের মধ্যে প্রধান ছিল অবন্তী , কোশল , বৎস এবং মগধ । এই চারটি রাজ্যের মধ্যে মগধই শেষ পর্যন্ত উত্তর ভারতে সর্বপ্রথম সার্বভৌম শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় ।
আধুনিক বিহার রাজ্যের দক্ষিণদিকের পাটনা ও গয়া জেলা নিয়ে প্রাচীনকালে মগধ রাজ্য গড়ে ওঠেছিল । এই রাজ্যের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বদিকে যথাক্রমে গঙ্গা , শোন ও চম্পানদী এবং দক্ষিণ দিকে বিন্ধ্যপর্বতের একাংশ অবস্থিত । বর্তমান রাজগীরের নিকট মগধের প্রাচীন রাজধানী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ অবস্থিত ছিল ।
মগধ অঞ্চলে নানাজাতির লােক বাস করত এবং আর্যদের নিকট তারা ব্রাত্য নামে পরিচিত ছিল । কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের ইতিহাসে মগধের গুরুত্ব যথেষ্ট । মগধেই জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল । আবার রাজনীতির ক্ষেত্রেই মগধ রাজ্যেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে এক অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল । পুরাণ ও সিংহলের বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ থেকে মগধ রাজগণের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় । তবে ঐতিহাসিক সূত্র হিসাবে বৌদ্ধগ্রন্থগুলিই অধিকতর নির্ভরযােগ্য বলে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন । ঐতিহাসিক যুগে মগধের যথাক্রমে তিনটি বিখ্যাত রাজবংশ রাজত্ব করেছিল — হর্ষঙ্ক । শৈশুনাগবংশ , নন্দবংশ ও মৌর্যবংশ ।
( ২ ) মগধের প্রাচীনতম রাজবংশ : পুরাণ ও মহাভারতের বিবরণ অনুসারে মগধের প্রাচীনতম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৃহদ্রথ । পুরানে এই বংশের কয়েকজন রাজার নাম পাওয়া যায় । মহাভারতের বিখ্যাত রাজা জরাসন্ধ মগধের রাজা ছিলেন । পুরানের বিবরণ অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই রাজবংশের অবসান হয় ।
হর্ষঙ্ক রাজবংশ : মগধের পরবর্তী রাজবংশ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় । কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে মগধের পরবর্তী রাজবংশ ছিল শিশুনাগ বংশ । আবার অনেকের মতে বৃহদ্রথ রাজবংশের পরই হর্ষঙ্কবংশ মগধের সিংহাসন অধিকার করে । বর্তমানে বহু ঐতিহাসিক এই মত সমর্থন করেন ।
বিম্বিসার হজ্জবংশের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও তিনিই ছিলেন এই বংশের প্রথম শক্তিশালী রাজা । সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫ থেকে ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তিনি মগধের সিংহাসনে আসীন ছিলেন । তাঁর উপাধি ছিল ‘শ্রেণীক’ । বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের সমসাময়িক ছিলেন এবং সম্ভবত এই দুজন ধর্ম প্রচারকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । তার রাজধানী গিরিব্রজ একটি সুরক্ষিত নগরী ছিল । চীনা ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায় যে তিনি রাজগৃহে একটি নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন । এই নতুন নগরীটি পাথরের দেওয়াল দিয়ে বেষ্টিত ছিল । বিম্বিসার প্রথমেই অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধের সম্প্রসারণ শুরু করেন । বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেও তিনি মগধের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন । কোশলরাজ প্রসেনজিৎ ভগ্নী কোশল দেশীকে বিবাহ করে তিনি কোশল রাজ্যের একাংশলাভ করেন । তাছাড়া লিচছবির রাজকন্যা চেল্লনা , বিদেহ রাজ্যের রাজকন্যা বাসবী ও মদ্ররাজকন্যা ক্ষেমার সঙ্গে ও বিম্বিসারের বিবাহ হয় । অবন্তীরাজ চণ্ড প্রদ্যোতের সঙ্গে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন । রাজ্যবিজেতা ছাড়াও বিম্বিসার একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন । তিনি মগধে একটি দক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন । তার আমলে আর্থিক দিক থেকেও মগধ অত্যন্ত সম্পদশালী হয়ে ওঠে ।
বৌদ্ধ বিবরণ থেকে জানা যায় যে বিম্বিসারকে বন্দী ও হত্যা করে সিংহাসনে আরােহণ করেন তার পুত্র কুণিক বা অজাতশত্রু । অজাতশত্রুর রাজত্বকালে মগধরাজ্যের যথেষ্ট বিস্তার ঘটে । তিনি কোশলরাজ প্রসেনজিৎকে যুদ্ধে পরাজিত করেন । অজাতশত্রু গঙ্গা ও শােননদীর সঙ্গম স্থলে পাটলিগ্রামে পাটলিপুত্র ( বর্তমানে পাটনা ) নগরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন । কৌশাম্বীর এক রাজকন্যাকে বিবাহ করে অজাতশত্রু নিজের ক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় করে তােলেন । অজাতশত্রুর প্রধান কৃতিত্ব হল বৃজি গণরাজ্যকে পরাজিত করে মগধ রাজ্যের আয়তন আরও বৃদ্ধি করা । এরফলে গঙ্গানদীর ওপর মগধের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ।
মহাবীর ও বুদ্ধদেব উভয়েই তিরােধান অজাতশত্রুর রাজত্বকালে ঘটে । রাজত্বকালের প্রথম দিকে অজাতশত্রু গৌতমবুদ্ধ ও তার প্রচারিত ধর্মের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব পােষণ করলে পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মমতেরই পৃষ্ঠপােষকতা করেন । বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর প্রথম বৌদ্ধসঙ্গীতি বা বৌদ্ধধর্ম সম্মেলন অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপােষকতার রাজগৃহে অনুষ্ঠিত হয় ।
অজাতশত্রুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র উদয়ন । তিনি পাটলিপুত্র শহরটি নির্মাণ করেন এবং সেখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । তাঁর রাজত্বকালে অবন্তীরাজ্যের সঙ্গে মগধের দীর্ঘকাল পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলেও , উদয়নের পক্ষে অবন্তীরাজ্যটি জয় করা সম্ভব হয়নি । বৌদ্ধসূত্র অনুসারে উদয়নের পর সিংহাসনে বসেন যথাক্রমে অনিরুদ্ধ , মুণ্ডু ও নাগদাসক । এই সব রাজারা ছিলেন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির । প্রজারা অত্যাচারী রাজা নাগদাসককে সিংহাসনচ্যুত করে মন্ত্রী শিশুনাগকে মগধের সিংহাসনে স্থাপন করলে সম্ভবত ৪১৯ খ্রিস্টাব্দে হর্ষঙ্ক রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে ।
( ৪ ) শৈশুনাগবংশ : মগধের সিংহাসনে শিশুনাগ প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশ শৈশুনাগবংশ নামে পরিচিত । মগধের এক সঙ্কটকালে শিশুনাগ সিংহাসনে আরােহন করেন । অবন্তী এবং কোশলরাজ্য এই সময় বারবার মগধ রাজ্য আক্রমণ করতে শুরু করে । শিশুনাগ মগধকে রক্ষা করার জন্য রাজধানী পুনরায় গিরিব্রজে স্থানান্তরিত করেন । শিশুনাগ অবন্তী রাজ্যের সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করে এই রাজ্যটি মগধের সঙ্গে যুক্ত করেন । সম্ভবত বৎস ও কোশল রাজ্যদুটিও তিনি জয় করতে সমর্থ হন । এই কারণে শিশুনাগকে উত্তর ভারতে মগধের সার্বভৌমত্বের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি বৈশালীতে তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন ।
শিশুনাগের মৃত্যুর পর তার পুত্র কালাশােক বা কাকবর্ণিন মগধের সিংহাসনে আরােহন করেন । তিনি রাজধানী পুনরায় পাটলিপুত্র নগরীতে স্থানান্তরিত করেন । তার রাজত্বকালেই বৈশালীতে বৌদ্ধধর্মসঙ্গীতির দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় । খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মধ্যভাগে আততায়ীর হাতে কালালশাক নিহত হলে তার নাবালক পুত্রদের দাবি অগ্রাহ্য করে মহাপদ্মনন্দ মগধের সিংহাসনে নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ।
( ৫ ) নন্দবংশ : নন্দরাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দের বংশপরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না । পুরাণ অনুযায়ী তিনি শূদ্র রমনীর গর্ভজাত শৈশুনাগ বংশের শেষ রাজা মহানন্দিনের পুত্র । তবে সমসাময়িক অন্যান্য সবগ্রন্থেই মহাপদ্ম নন্দকে নীচজাতি সদ্ভূত বলে উল্লেখ করা হয়েছে । পুরাণের বিবরণ থেকে জানা যায় যে মহাপদ্মনন্দ এক সার্থক রাজ্যবিজেতা ছিলেন । পুরাণে তাকে ‘সর্বক্ষত্ৰান্তক’ ‘দ্বিতীয় পরশুরাম বা ভার্গব’ ‘একরাট’ বা ‘সার্বভৌম সম্রাট’ এবং পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে । তিনি উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় শক্তিগুলাের মূল উৎপাদন করেন । কুরু পাঞ্চাল ,সুরসেন , মিথিলা , কাশী , ইস্ককু , কলিঙ্গ , হৈহয় , অস্মক প্রভৃতি রাজ্য তিনি মগধের অন্তর্ভূক্ত করেন । সম্ভবত এই সব অঞ্চল ছাড়াও কোশল ও কুন্তল অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের দক্ষিণাংশ এবং কর্ণাটকের পশ্চিমাংশ মহাপদ্মনন্দের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । মহাপদ্মনন্দকে ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট আখ্যা দেওয়া হয়েছে । গ্রীক বিবরণ থেকে জানা যায় যে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময় পাঞ্জাবের পূর্ব সীমানা থেকে ভারতের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং পাটলিপুত্র থেকে সেই সাম্রাজ্য পরিচালিত হত । সম্ভবত ২৮ বছর মহাপদ্মনন্দ রাজত্ব করেন এবং সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক দিক ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকে তিনি মগধকে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত করেন । মহাপদ্মনন্দ উগ্রসেন নামেও পরিচিত ছিলেন ।
পুরাণে বলা হয়েছে মহাপদ্মনন্দের মৃত্যুর পর তার আট পুত্র মগধের সিংহাসনে আরোহন করেন । কিন্তু তারা একসঙ্গে অথবা এক একজন করে মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন সে , সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি । মহাবােধিবংশে মহাপদ্মনন্দের আট পুত্রের নাম পান্ডুক , পাণ্ডুগতি , গােবিসানক , রাষ্ট্রপাল, দশসিদ্ধক , ভূতপাল , কৈবর্ত ও ধন বলে উল্লেখ করা হয়েছে । সম্ভবত এই আটজন রাজা মােট বাইশ বছর রাজত্ব করেন । কিন্তু নন্দবংশের প্রথম রাজা মহাপদনন্দ এবং শেষ রাজা ধননন্দ ব্যতীত অন্য কোন রাজার রাজত্বকাল সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না । নন্দরাজবংশের শেষ রাজা ধননন্দের রাজত্বকালে গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডার উত্তর পশ্চিমভারত আক্রমণ করেন কিন্তু তার সামরিক শক্তির সংবাদ পেয়ে তিনি পূর্বভারতের দিকে অগ্রসর হতে সাহস করেন নি । তবে ধননন্দ ছিলেন অত্যাচারী ও ধনলিপ্স এবং তার বিরুদ্ধে জনসাধারণের অসন্তোষের অসংখ্য কারণ ছিল । এরূপ অবস্থায় ধননন্দের বিরুদ্ধে অসন্তোষের সুযােগ নিয়ে তক্ষশীলা নগরের অধিবাসী চাণক্য নামে এক ব্রাক্ষ্মণের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধে নন্দদের শাসনের অবসান ঘটান । মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তই ভারতবর্ষকে এক রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়ে আসেন ও রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা করেন ।
( ৬ ) মৌর্যবংশ : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পর তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসন লাভ করেন । সম্ভবত তিনি দক্ষিণ ভারতের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হন । বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তার পুত্র অশােক পিতৃ সিংহাসন লাভ করেন । পিতাও পিতামহের আদর্শ অনুসরণ করেই অশােক রাজ্যবিস্তারে মনােনিবেশ করেন । কলিঙ্গ বিজয় মগধের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করার মাধ্যমে মগধের রাজ্য বিস্তারের যে সূচনা করেন , অশােকের কলিঙ্গ জয়ের দ্বারা তার সমাপ্তি ঘােষিত হয় । তাছাড়া কলিঙ্গযুদ্ধে বীভৎসদৃশ্য অশােকের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি রাজ্যজয়ের নীতি পরিত্যাগ করেন । এমন কি তিনি তাঁর উত্তরপুরুষদের যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য জয়ের নীতি ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন । তার ফলে সাম্রাজ্যবাদী মগধের রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটে ।