দিল্লির সুলতানি রাজত্বের পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর দিল্লির সুলতানি রাজত্বের পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে delhir sultani rajotter potoner karonguli alochona koro


উত্তর : তুর্ক- আফগান সুলতানগণ দিল্লিতে মােট ৩২০ বছর ( ১২০৬ - ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ ) রাজত্ব করেন । দিল্লির সুলতানগণের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজি সর্বপ্রথম দাক্ষিণাত্যজয় করে সমগ্র ভারতব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন করেন । মহম্মদ বিন তুঘলকও সারা ভারতব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন । তবে তারই সময় থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দরুণ তুর্ক আফগান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় । ফিরােজ তুঘলকের আমলে , সুলতানী সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হয়ে দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল । সৈয়দ ও লােদী বংশীয় সুলতানগণ কতকগুলি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করলেও দিল্লির সাম্রাজ্যের পূর্বতন গৌরব ও শক্তি ফিরে আসেনি । এরপর দিল্লির সুলতানি শাসন ভেঙে পড়ে । ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মােগল সম্রাট বাবরের হাতে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় । 


দিল্লির সুলতানী রাজত্বের পতনের কারণ প্রসঙ্গে বলা যায় যে , দিল্লির সুলতানী শাসন ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই তার পতনের বীজ নিহিত ছিল । সাম্রাজ্যটির ভিত্তি ছিল স্বৈরাচারী সুলতানের ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল । তুর্ক আফগান সুলতানেরা কোনােদিন নিজেদেরকে ভারতীয় সুলতান হিসাবে গণ্য করেননি । সুলতানগণ অমর বিজয়ী হিসাবে এসেছিলেন , তাঁরা বিদেশীই রয়ে গিয়েছিলেন । বিজয়ী অ -ভারতীয় চরিত্রের কোনাে পরিবর্তন না হওয়ায় ভারতীয় হিন্দুরা ঐ সাম্রাজ্যের সমকক্ষীয় অংশীদার হিসাবে নিজেদেরকে গণ্য করতে পারেনি । মুসলমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিদ্বেষ রয়েই গিয়েছিল । হিন্দুদের স্বাভাবিক আনুগত্য লাভ না করতে পারায় সুলতানী শাসনব্যবস্থাটি নীতিগতভাবে একটি বৈদেশিক ও অপবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভারতীয় জনমানসে স্থান পায় । তাই সুলতানী সাম্রাজ্যটি একটি অতি সংকীর্ণ ভিত্তির উপর দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল । এগুলির প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ ভাবই তার পতনের প্রথম কারণ ছিল । 
   
বৃহত্তর প্রজাগণের আনুগত্যহীনতা সত্ত্বেও তুর্ক আফগান সুলতানরা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মের অসহিষ্ণু ও নিপীড়ক । হিন্দুদের প্রতি ধর্মগত কারণে অবিচার হিন্দু সমাজে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করে । তারা সুলতানি শাসনের অবসান কামনা করে ।  এই হিন্দু বিদ্বেষই মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষ দিকে সুস্পষ্ট বিদ্রোহের রূপ গ্রহণ করে । উত্তর ভারতে রাজপুত জাতির নেতৃত্বে হিন্দুদের মধ্যে যে নবজাগ্রত শক্তির উত্থান ঘটে তা সুলতানি শাসনকে বিনাশ করতে সাহায্য করে । এমন হিন্দু শক্তিই আবির্ভূত হয় দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনে । এই ঘটনাগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে , হিন্দুরা বিনা প্রতিবাদে অবনত মস্তকে মুসলমান সুলতানের শাসনকে কোনােদিন নিজস্ব শাসন বলে মনে করেনি । সুযােগ পেলেই হিন্দুরা বিদ্রোহ করেছে , যুদ্ধ করেছে সুলতানের শাসনের বিরুদ্ধে । 

তুর্ক - আফগান জাতির গােষ্ঠীগত মনােভাব , স্বাতবিলাস ও ব্যক্তিগত ইর্ষা বিভিন্ন রাজ পরিবারের মধ্যে গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও প্রকাশ্য সংঘর্ষ প্রভৃতি অসংখ্য বার দেখা যায় । এতে তুর্ক - আফগান রাজশক্তি ক্ষীয়মান হয়ে ওঠে । সুলতানদিগের চারিত্রিক গুণাবলীর অভাব ও অভিজাত শ্রেণির স্বার্থপরতা বিভিন্ন সময়ে সুলতানি সাম্রাজ্যকে অবনতির পথে ঠেলে দিয়েছিল । এদের মধ্যে অনেকেই শাসনকার্যের অনপুযুক্ত ছিলেন । তাদের মদ্যপান , উৎশৃঙ্খল আচরণ , অহেতুক হিন্দু নির্যাতন সুলতানি শাসনের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তােলে । অধিকাংশ অভিজাতই ক্রমশ বিলাস ব্যসনে অভ্যস্ত ও ইন্দ্রিয়াসক্ত হয়ে পড়েন । তাদের মন সামরিক স্পৃহা হারিয়ে দিনে দিনে ষড়যন্ত্রবিলাসী হয়ে ওঠে । ক্ষমতালােভী অভিজাততন্ত্র ‘জায়গীরদার’ হিসাবে স্বাধীন চিত্ততা প্রদর্শনে বেশী আগ্রহী হয়ে ওঠে । একদিন তারা ছিলেন সুলতানি সাম্রাজ্যের স্তম্ভম্বরূপ, অভিজাতদের অবনতি সুলতানি রাজত্বের অবক্ষয় ঘটায় । 
 

মহম্মদ বিন তুঘলকের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপ সুলতানি শাসনের পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী । তাঁর অবাস্তব ও বৃহত্তর পরিকল্পনাগুলি রাজকোষকে শূন্য করে দেয় । তার ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনায় আহত সাম্রাজ্যিক বিফলতাকে তার উত্তরাধিকারীরা সামাল দিতে ব্যর্থ হন । ফিরােজ তুঘলক আরও দুর্বল শাসক ছিলেন । জায়গির প্রথাকে পুনঃপ্রবর্তন করে হস্তচ্যুত বিদ্রোহী প্রদেশগুলি পুনঃজয়ের জন্য সচেষ্ট মনােভাব না দেখিয়ে তিনি সাম্রাজ্যের আরও বেশি ক্ষতি করেন । কেন্দ্রীয় শক্তি তার হাতে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে । 


কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযােগ প্রাদেশিক শাসনকর্তারা ক্রমশঃ সাম্রাজ্যিক স্বার্থের পরিবর্তে নিজ নিজ স্বার্থপূরণে সক্রিয় হয়ে ওঠে পড়ে । তাদের স্বাধীন চিত্ততার দরুন অতি দ্রুত বাংলা , গুজরাট , মালব দেশ প্রভৃতি সাম্রাজ্যচ্যুত হয়ে পড়ে । সে যুগে দ্রুত এবং উপযুক্ত যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাবে সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলিকে দৃঢ় নজরে রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল । যােগাযােগ ব্যবস্থার এই অসুবিধা ক্ষমতালিস্পু প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতাপ্রেমী করে তােলে । 



বারংবার বহিরাগত মােঙ্গল আক্রমণ তুর্ক রাজশক্তিকে বিশেষ ভাবে আঘাত করে তাকে দুর্বল করে দেয় । দৃঢ়চেতা শাসক গিয়াসউদ্দিন বলবন ,আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া অধিকাংশ সুলতানই মােঙ্গলদিগের প্রতি দুর্বল মনােভাব প্রদর্শন করেন । শেষ পর্যন্ত মােঙ্গল বীর তৈমুরলঙ তুর্ক - আফগান সাম্রাজ্যটিকে ছারখার করে দেন ( ১৩৯৮ খ্রিঃ ) । তার দেওয়া আঘাতে দিল্লীর সিংহাসনের মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে যায় । রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি শিথিল হয় । সামরিক শক্তির বিনাশ ঘটে । এসব নানাবিধ কারণের ঘাত - প্রতিঘাতের ফলে দিল্লীর সুলতানীর অবসান ঘটে । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন