উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা : গুপ্তবংশীয় সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত ‘ মহেন্দ্রাদিত্য ’ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন । সম্ভবত তিনি ৪১৫ থেকে ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । প্রথম কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্যের শাসন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না , তবে মুদ্রা ও শিলালেখ থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয় যে , তার সময়ে গুপ্তসাম্রাজ্যের আয়তন হ্রাস পায় নি । পূর্বদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত এই সময় গুপ্তসাম্রাজ্যের বিস্তৃত ছিল । তিনি যে শক্তিশালী রাজা ছিলেন তা তার দ্বারা অনুষ্ঠিত অশ্বমেধ যজ্ঞের দ্বারাই প্রমাণিত হয় । তার আমলের প্রথম দিকে হূনদের আক্রমণও তিনি প্রতিরােধ করতে সমর্থ হন । প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষদিকে নর্মদা অঞ্চলের পুষ্যমিত্ররা বিদ্রোহ ঘােষণা করে । যুবরাজ স্কন্দগুপ্তকেই বিদ্রোহ দমন করতে পাঠানাে হয়েছিল । স্কন্দগুপ্ত এই সঙ্কট থেকে গুপ্তসাম্রাজ্যকে রক্ষা করে সম্রাট কুমারগুপ্তের যশ ও গৌরব অক্ষুন্ন রাখেন । কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করেছিলেন ।
প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরােহণ করেন । স্কন্দগুপ্তই গুপ্তবংশের শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট । তিনি ৪৫৫ থেকে ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । সিংহাসনে আরােহণের পর স্কন্দগুপ্তের সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হল হূন আক্রমণ থেকে গুপ্তসাম্রাজ্যকে রক্ষা করা । স্কন্দগুপ্ত হূনজাতিকে এমন ভাবে পরাজিত করেন যে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হূনরা আর ভারত আক্রমণ করতে সাহসী হয় নি । এই আক্রমণ থেকে গুপ্তসাম্রাজ্যকে রক্ষা করে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে বর্বর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন । তবে সামরিক সাফল্যই স্কন্দগুপ্তের একমাত্র কৃতিত্ব নয় । তিনি বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্য সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রাখেন । ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়ে ছিলেন । সুদক্ষ যােদ্ধা ও সুশাসক স্কন্দগুপ্ত ছিলেন গুপ্তরাজবংশের শেষ সার্থক সম্রাট । কথাসরিৎসাগর থেকে স্কন্দগুপ্তের কার্যকলাপ জানা যায় ।
( ২ ) গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণ সমূহ : সমুদ্রগুপ্ত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সামরিক নৈপুণ্য ও সুদক্ষ নেতৃত্বের ফলে যে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে তার পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ গুপ্তসাম্রাজ্য সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় । প্রকৃত পক্ষে পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্রমে হীনবল হয়ে পড়তে থাকে এবং পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্যগুলাের পতনের মতাে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের মূলেও কোন একটি মাত্র বিশেষ কারণ ছিল না , বহুবিধ কারণের সমন্বয়ের ফলেই এই সাম্রাজ্যের পতনের কারণ প্রশস্ত হয় । স্কন্দগুপ্তই ছিলেন গুপ্তবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা । তার পরে পুরুগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত , বালাদিত্য , দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত প্রভৃতি রাজাদের আমলে গুপ্তসাম্রাজ্যের শক্তি ও আয়তন ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটে । এই সাম্রাজ্যের পতনের কয়েকটি কারণ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায় ।
প্রথমত , অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে । প্রথম কুমারগুপ্তের আমলে পুষ্যমিত্র জাতির বিদ্রোহের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে । স্কন্দগুপ্তকে বিদ্রোহী পুষ্যমিত্রদের সাময়িক ভাবে দমন করতে সমর্থ হলেও তাদের শক্তিখর্ব করা তাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি । বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ করে তারা গুপ্তসাম্রাজ্যের ভিত্তিকে শিথিল করে তােলে । অপর দিকে সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে বাকাটক রাজবংশের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হলেও উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষের অবসান কখনও ঘটে নি ।গুপ্তদের দুর্বলতার সুযােগে বাকাটকগণ বারবার গুপ্তসাম্রাজ্য আক্রমণ করতে শুরু করলে চারিদিকে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ।
দ্বিতীয়ত , অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বাকাটকদের আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্য যখন ক্ষত বিক্ষত - তখনই বিদেশী হুনজাতি । এই সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে শুরু করে । স্কন্দগুপ্তের পর দুর্বল গুপ্ত সম্রাটদের পক্ষে হূনদের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয় নি । মালব ও পাঞ্জাব অধিকার করে তারা মধ্যপ্রদেশের এরান জেলা পর্যন্ত অগ্রসর হয় । হূনদের আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা যায় । অনেকে মনে করেন যে হূনজাতির আক্রমণই ছিল গুপ্তদের পতনের প্রধান কারণ ।
তৃতীয়ত , অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে । এই দুর্বলতার সুযােগে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীরা এবং প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে । সাম্রাজ্যের অনেক অংশের শাসকগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন । কনৌজের মৌখরিগণ , বলভির মৈত্ৰকগণ ও গৌড়ের শাসকগণ গুপ্তসম্রাটদের আনুগত্য অস্বীকার করেন । এই ভাবে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।
চতুর্থত , মালবদেশের শাসনকেন্দ্র মান্দায়সারের শাসনকর্তা যশােধর্মনের অভ্যুদয় গুপ্তসাম্রাজ্যের একচ্ছত্র ক্ষমতা চিরদিনের মতাে বিলুপ্ত করে দেয় । যশােধর্মন হূন দলপতি মিহিরগুলকে পরাজিত করেছিলেন এবং সম্রাট উপাধি গ্রহণ করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সম্ভবত তিনি মালবের কোন সামন্ত বংশােদ্ভূত ছিলেন । মান্দাসােরে প্রাপ্ত একটি অনুশাসন থেকে জানা যায় যে যশােধর্মনের রাজ্য ব্ৰক্ষ্মপুত্র থেকে আরবসাগর এবং হিমালয় থেকে পূর্বঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । যশােধর্মনের এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা প্রত্যক্ষভাবে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন সূচিত করে ।
পঞ্চমত : অযােগ্য ও দুর্বল গুপ্তরাজগণের স্বার্থপরতা ও আত্মদ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যের পতনকে আরও সুনিশ্চিত করে তােলে । তারা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যের এক একটি অংশ আত্মসাৎ করতে চেষ্টা করেন । এমনকি তারা শক্তিশালী প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও শুর করেন । এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তিই কেবল হ্রাস পায় নি, তাদের মর্যাদাও নষ্ট হতে থাকে ।
ষষ্ঠত , গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক সঙ্কট । অভ্যন্তরীণ গােলযােগ ও বৈদেশিক আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের আর্থিক সম্পদের প্রচুর ক্ষতি হয় । ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধিও নষ্ট হতে শুরু করে । গুপ্তযুগের শেষ দিকে মুদ্রার অপ্রাচুর্য ও ধাতুর নিম্নমান থেকে প্রমাণিত হয় যে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামাে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । দেশের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযােগে সামন্ত রাজারাও প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ কেন্দ্রীয় রাজকোষে অর্থ পাঠানাে বন্ধ করে দেয় । রাজস্ব আদায়েও গাফিলতি দেখা দেয় । তাছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যে যে অর্থ রাজকোষে আসত তাও বন্ধ হয়ে যায় । ঠিক এই সময়ই পশ্চিম রােম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের বহির্বাণিজ্যও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
সপ্তমত , পরবর্তী গুপ্তসম্রাটদের ধর্ম ও তাদের সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কিছু পরিমাণে দায়ী । পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের মধ্যে অনেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হন । তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার দিকে কোনভাবেই আগ্রহী ছিলেন না । গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাটদের এই নীতি অনেকাংশে দায়ী । সামরিক শক্তির দুর্বলতার ফলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারও কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করতে সাহসী হয়ে ওঠে । চীনা পরিব্রাজক হিউ - এন - সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় পরবর্তী গুপ্তসম্রাটগণ দায় ও দানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন , শৌর্য বীর্যের জন্য নয় ।
( ৩ ) উপসংহার : গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ভারতের ইতিহাসে মৌর্যসাম্রাজ্য থেকে মােগলসাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণগুলাে একই ধরনের নেতৃত্বের দুর্বলতা , বৈদেশিক আক্রমণ , প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহ , অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতার লােভ এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট । গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম দেখা যায় নি ।