উত্তর : ( ১ ) কুষাণদের পরিচয় : চীনা ঐতিহাসিক সু-মা - শিয়েন ও প্যানকুর রচনা থেকে জানা যায় যে কুষাণরা ছিল যাযাবর ইউ - চি জাতির শাখা । ইউ -চি জাতি আদিতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পশ্চিম চীনের কান - সু এবং নিং -শিয়া প্রদেহে বসবাস করত । সম্ভবত তারা সেই সময় যাযাবর যােদ্ধা জাতি হিসাবে পরিচিত ছিল । ১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিউং-নু ( হ্ন) নামে এক উপজাতি এসে তাদের এই বাসস্থান থেকে বিতাড়িত করে এবং যাযাবর জীবন গ্রহণে বাধ্য করে । চীন থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউ - চি জাতি পশ্চিম দিকে যাত্রা করে । পশ্চিমদিকে যাত্রার পথে ইউ -চি জাতি তাকলামাকান বা গােবি মরুভূমির উত্তর দিকে চলে আসে এবং শক জাতির সম্মুখীন হয়ে এই গােষ্ঠীর রাজা বা নেতাকে যুদ্ধে নিহত করে । ইসিককুল অঞ্চল থেকে ইউ - চি জাতির একটি শাখা মূলগােষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে এবং তিব্বত সীমান্তে বসবাস করে । ইউ -চি জাতির মূল শাখার নাম হয় তা ইউ -চি বা বৃহৎ ইউ - চি । এই শাখা আরও পশ্চিমে এগিয়ে এসে অক্ষু বা আমুদরিয়া নদীর উপত্যকায় চলে আসে এবং এই স্থান থেকে শাসকদের বিতাড়িত করে সেখানে বসবাস শুরু করে । কিন্তু শিরদরিয়া উপত্যকায় ইউ - চি জাতি বেশিদিন বাস করতে পারে নি । উ -সূন জাতি হিউং - নুবা হ্নদের সাহায্য নিয়ে তাদের এই স্থান থেকে বিতাড়িত করে । বাসচ্যুত ইউ -চি জাতি আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে অক্ষু বা আমুদরিয়া নদীর তীরে আসে । এই স্থান থেকে তারা শকদের পুনরায় বিতাড়িত করে । এরপর ইউ - চি জাতি সগভিডয়ানা ও তাহিয়া অধিকার করে তাদের রাজ্য স্থাপন করে ।
পন্ডিতদের মতে তা -হিয়া বলতে ব্যাকট্রিয়া বুঝায় ।তবে ইউ - চি জাতি ব্যাকট্রিয়া কাদের কাছ থেকে অধিকার করে এই সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় । পূর্বে মনে করা হত যে ইউ -চি জাতি শকদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে ব্যাকট্রিয়া দখল করেছিল । কিন্তু প্যানকুর গ্রন্থে শকদের নাম না থাকায় অনেকে এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ।ডক্টর বি. এন . মুখার্জীর মতে ব্যাকট্রিয়া তখন ইন্দো -গ্রীকদের অধিকারে ছিল এবং ১৩০ - ১২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চল থেকে ইন্দো - গ্রীকদের বিতাড়িত করে ব্যাকট্রিয়া ইউ -চিরা অধিকার করে । প্যান -কু এবং ফ্যান- ই উভয়ের রচনা থেকে জানা যায় যে , ব্যাকট্রিয়ায় বসবাসের পর ইউ - চিরা তাদের যাযাবর জীবন ত্যাগ করে । কিন্তু এই সময় ইউ -চি জাতি একতা হারিয়ে পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় । এই পাঁচটি শাখার মধ্যে একটি শাখার নাম ছিল কুইয়া বা কুষাণ । ডক্টর বি. এন . মুখার্জীর মতে গােড়ার দিকে এই পাঁচটি শাখা মূল ইউ - চি জাতির অধীনে ছিল । মিয়াওস নামে এক কুষাণ শাসনকর্তার মুদ্রা পাওয়া যায় তাকেই প্রথম স্বাধীন কুষাণরাজা বলে মনে করা হয় । মুদ্রা ছাড়া আর কোন তথ্য তাঁর সম্পর্কে জানা যায় না । কুষাণদের প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন কুজলা । খ্রীস্টপূর্ব ৩০ অব্দ নাগাদ কুইওয়াং বা কুষাণ শাখার নেতা কুজলা কদফিসেস । স্বাধীনতা ঘােষণা করার পূর্বে কুজলা কদফিসেস ছিলেন কুষাণ শাখার যাবুগ বা শাসনকর্তা ।
( ২ ) কুজলা কফিসেস : কুজলা কদফিসেস কুষাণদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করেন । তারপর তিনি পার্থিয়া জয় করেন । কাও - ফু বা কাবুল , পাে - তা বা কাবুলের নিকটবর্তী স্থান অথবা পেশােয়ার , কি-পিন বা কাশ্মীর (মতান্তরে কাফ্রিস্তান) অধিকার করেন । তবে কুজলা কদফিসেস ভারতের অভ্যন্তরে বেশিদূর প্রবেশ করতে পারেন নি । উত্তর - পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ এবং কি-পিন বা কাশ্মীর তিনি অধিকার করেন । সম্ভবত পার্থিয়দের পরাজিত করে তিনি এই অধিকার স্থাপন করেন । কতকগুলাে মুদ্রার একপিঠে ইন্দো গ্রীক রাজা হারমাইয়স ও অপরপিঠে কুজলা কদফিসেসের নাম পাওয়া যায় । ডক্টর এস . চট্টোপাধ্যায় বলেন যে, হারমাইয়স শক আক্রমণের বিরুদ্ধে কুজলার সহায়তা নিয়েছিলেন । তাই এই দ্বৈতমুদ্রা তৈরি করা হয় । কিন্তু হারমাইয়স ও কুজলার মধ্যে সময়ের ব্যবধান এত বেশি যে, এই মত অনেকে অগ্রাহ্য করেন । তবে অনেকে মনে করেন যে হারমাইয়সের মুদ্রার ওপর কুজলা তাঁর নিজের আধিপত্যের কথা প্রচার করার জন্য নিজের নাম খােদাই করেছেন । সম্ভবত কুজলা কদফিসেসের সঙ্গে হারমাইয়সের কোন প্রত্যক্ষ যােগাযােগ ছিল না । কুজলা কদফিসেস ৮০ বছর বয়সে মারা যান । তাঁর মুদ্রায় তিনি যাবুগ (দলনেতা শাসনকর্তা ) ‘মহারাজ’ (মহনা রাজা ), ‘রাজাতিরাজ’ (রাজাদের রাজা ) , সচধর্ম ( সত্য ধর্মে স্থির) প্রভৃতি উপাধিগ্রহণ করে । শেষােক্ত উপাধিটি সম্ভবত তার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের ইঙ্গিত বহন করে ।
( ৩ ) বিম কদফিস বা দ্বিতীয় কদফিসেস । কুজলা কদফিসেস এর পর বিম কদফিসেস বা ইয়েন কাও - চেন সিংহাসনে বসেন । তিনি দ্বিতীয় কদফিসেস নামেও পরিচিত । স্টেন কোনাে - র মতে , ৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিম কদফিসেস সিংহাসনে বসেন এবং এই সন থেকে তিনি শকাব্দের পত্তন করেন । কিন্তু ডক্টর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী সহ অনেকেই এই মত মেনে নিতে সম্মত হন নি এবং তারা মনে করেন যে সম্রাট কনিষ্ক শকাব্দ প্রবর্তন করেন । কোন কোন পন্ডিত দাস্ত - ই -ই-নাবুর শিলালিপির ভিত্তিতে মনে করেন যে বিম কদফিসেস ৩২ খ্রীস্টাব্দে রাজত্ব করতেন । তবে অধিকাংশ এই ঐতিহাসিকের মতে বিম কদফিসেসের প্রথম খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে অথবা দ্বিতীয়ভাগের গােড়ার দিকে রাজত্ব করতেন ।
বিম কদফিসেস তার পিতার রাজ্য ব্যাকট্রিয়া সহ উত্তর পশ্চিমভারত ও কাশ্মীর বা কি -পিন লাভ করেন । তার সঙ্গে তিনি তক্ষশীলা ও পাঞ্জাব যুক্ত করেন । পরে তাঁর রাজ্য সীমা তিনি আরও বৃদ্ধি করেন এবং ভারতের অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চল জয় করেন । বিম কদফিসেসের মুদ্রা থেকে জানা যায় যে তিনি কান্দাহার ও সেন - তু অধিকার করেন । সেন - তু বলতে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল বুঝায় । নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলে বিম কদফিসেস -এর মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে । এজন্য এই অঞল তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয় । সম্ভবত বিম -কদফিসেসের সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান থেকে গঙ্গা উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । বিম কদফিসেসের মুদ্রায় ‘মহীশ্বর’ নাম খােদাই এবং শিবমূর্তি, যাড় ও ত্রিশূল চিহ্ন দেখা যায় । এজন্য তাকে শৈবধর্মের প্রতি অনুরক্ত মনে করা হয় ।
ঐতিহাসকিদের মতে বিম কদফিসেসের রাজত্বকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তার রাজত্বকালে ভারতের সঙ্গে চীন ও রােমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্য খুব প্রসার লাভ করে । রােমিলা থাপারের মতে রােমান স্বর্ণ মুদ্রা ‘দিনারির’ অনুকরণে বিম কদফিসেস তার স্বর্ণমুদ্রা নির্মাণ করেন এবং তার আমল থেকেই ভারতীয় স্বর্ণ মুদ্রার মান খুবই উন্নত হয় ।