উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা — ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে ৩৭ বছর রাজত্ব করার পর ২৩২ খ্রিস্টাব্দে অশােকের মৃত্যু হয় । তার মৃত্যুর পরই মৌর্যদের রাজনৈতিক পতন শুরু হয় । অশােকের মৃত্যুর পরে পঁচিশ বছরের মধ্যে গ্রীকগণ হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে মৌর্য সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে নিজেদের অধিকার স্থাপন করে এবং পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে সিংহাসন থেকে মৌর্যদের বিতাড়িত করে শুধু রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় । সুতরাং অশােকের মৃত্যুর পর অত্যন্ত দ্রুত মৌর্য সাম্রাজ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই এবিষয়ে অশােকের দায়িতের কথা উল্লেখ করেন ।ঐতিহাসিক ভাণ্ডারকার মনে করেন যে অশােকের রাজ্যবিজয়ের পরিবর্তে ধর্মবিজয়ের নীতি পরােক্ষভাবে অনেক উপকার সাধন করলেও এবং নৈতিক গৌরবের কারণ হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে তা খুব ক্ষতিকর ছিল । তিনি মনে করেন যে আধ্যাত্মিক উন্নতি প্রবণ হিন্দুগণ আরও শান্তিপ্রিয় এবং ধর্মপ্রাণ হয়ে ওঠে । ফলে সামরিক শক্তিবৃদ্ধি , রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপন এবং পার্থিব সূখ -সম্পদের দিকে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের বিতৃষ্ণা দেখা দেয় । কৌটিলের পরে মগধ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির এবং জাতীয় ঐক্য স্থাপনের সম্ভাবনার যুগেই রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার অগ্রগতি ও তা বাস্তবকে রূপায়ণ অকস্মাৎ রুদ্ধ হয়ে যায় । অশােকের নতুন দৃষ্টি ভঙ্গী প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীভূত জাতীয়রাষ্ট্র ও বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের পথে বাধার সৃষ্টি করে । অশােকের রাজত্বকালেই উত্তর পশ্চিমসীমান্তে বিপদজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এবং ব্যাকট্রিয় গ্রীকগণ হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর আঘাত করতে শুরু করে । আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময়ও গ্রীকগণ মগধের সামরিক শক্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল । কিন্তু অশােকের বৈদেশিক নীতির দুর্বলতা এবং সামরিক শক্তির প্রতি অবহেলার ফলে শক, পহুব , কুষাণ , হূণ , গুর্জর প্রভৃতি জাতি অবাধে ভারতে প্রবেশ করে রাজ্য স্থাপনের সুযােগলাভ করে ।
( ২ ) অন্যান্য মতামত — ঐতিহাসিক ভাণ্ডকার ছাড়াও ঐতিহাসিক জয়সােয়ল এবং হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অশােকের রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযােগ আনয়ন করেন । জয়সােয়াল বলেন যে প্রকৃতিগত ভাবে যিনি কোন মঠের অধ্যক্ষ হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন , ইতিহাসের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি সিংহাসনে আরােহন করে ইতিহাসের গতিকে শুধুমাত্র কয়েক শতাব্দী নয় , কয়েক সহস্র বছর পিছিয়ে দিয়েছেন । ডক্টর হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী বলেন যে অশােকের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙন রােধ করার ক্ষমতা ছিল না । কলিগের যুদ্ধে আর্তদের বিলাপের সঙ্গে সঙ্গেই মগধের যােদ্ধাদের রণহুঙ্কারের অবসান ঘটে । পূর্বসূরীদের সামরিক বিজয়ের নীতির পরিবর্তে অশােক ধর্মবিজয়ের নীতি গ্রহণ করেন এবং সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির অপূরণীয় ক্ষতি করেন । এমনকি অশােক তার পুত্র ও পৌত্রদের পক্ষ থেকেও যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির পথ অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দেন । অশােকের পরবর্তী রাজারা ‘ভেরী ঘােষ’ অপেক্ষা ‘ধর্মঘােষের’ সঙ্গে অধিকতর পরিচিত ছিলেন । প্রকৃত পক্ষে কলিঙ্গের যুদ্ধের পর ২৯ বছর যাবৎ অশােক কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি । এবং অত্যন্ত আত্মতৃপ্তির সঙ্গে তিনি ঘােষণা করেন যে ‘ভেরী ঘােষ’ ‘ধর্মঘোষ’ এ পরিণত হয়েছে । চীনের ঐতিহাসিক হৌ হানসু বলেন যে ভারতবাসী বুদ্ধের বাণী অনুসরণ করে এবং কোন প্রাণী হত্যা না করা এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করা তাদের স্বভাবগত হয়ে উঠেছে । মৌর্যসম্রাটগণ পূর্বে নিজেরাই যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতেন এবং সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল , কিন্তু যেভাবে পুষ্যমিত্র সৈন্যদের উপস্থিতিতে রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন তা থেকে প্রমাণিত হয় যে শেষের দিকে মৌর্যরাজাদের সঙ্গে সৈন্যদের ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক ছিলনা । অপরদিকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রচুর ধনরত্ন দানের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হয় । তাছাড়া অশােকের আমলে অতিরিক্ত স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার ফলে রাজ্যের সর্বত্র যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা দেখা দেয় অশােকের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না ।
( ৩ ) অশােকের দায়িত্ব — উপরি উক্ত আলােচনা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় যে, সাধারণভাবে ঐতিহাসিকগণ মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশােককে দায়ী করেন । তাঁদের মতে মগধের চিরাচরিত রাষ্ট্রনীতি এবং কৌটিলের রাজনৈতিক আদর্শ পরিত্যাগ করে অশােক মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পথ উপযুক্ত করেন । প্রকৃতপক্ষে এই সব ঐতিহাসিকগণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বর্ণিত রাষ্ট্রনীতি , অপরদিকে গার্গসিংহিতার যগনপুরাণ অধ্যায়ের উদসহি ( উদয়িন ) , শালিস্তকের কিংবদন্তী এবং দিব্যাবদানে উল্লিখিত অশােক কর্তৃক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেদান করার কাহিনীর ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন । ডক্টর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ভারতীয়দের অহিংস চরিত্রের কথা উদঘাটন করার জন্য এমন কি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হৌ হানসুর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেন । ভাণ্ডারকার তাঁর মতের সমর্থনে জোরালাে যুক্তি হিসাবে বলেন যে চক্রবর্তী ধার্মিক ধর্মরাজের আদর্শ অশােকের চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে না রাখলে তিনি ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের তামিল রাজ্য সমূহ জয় করে এবং ভারতের প্রাকৃতিক সীমানা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে রােম সাম্রাজ্যের মতাে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গঠনে সমর্থ হতেন ।কিন্তু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আদর্শই যে মৌর্য সাম্রাজ্যের সংগঠনের মধ্যে পরিণতি লাভ করে তা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য নয় । গার্গী সংহিতার কাহিনীর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ পােষণ করেন । আর হৌ হানসু কোন দিনই ভারতবর্ষে আসেন নি তার বিবরণে বাস্তব অপেক্ষা কল্পনারই বেশি গুরুত্বলাভ করা অসম্ভব নয় । প্রকৃতপক্ষে অশােকের অহিংস নীতি কোনক্রমেই অবাস্তব ছিল না । শিলালিপিতে সৈন্যবাহিনীকে দুর্বল করার কোন উল্লেখ নেই ।
মহামহােপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্রাত্মণ বিপ্লবকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অবনতি ও পতনের কারণ বলে বর্ণনা করেন । ব্রাত্মণ অসন্তোষের কারণ হিসাবে তিনি পশুবলি বিরােধী বিধানের কথা উল্লেখ করেন । কিন্তু তার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে বলা যায় যে পশুবলি বন্ধ হওয়ার ব্রাত্মণদের অসন্তুষ্ট হবার কোন কারণ ছিল না । কেননা অশােকের আমলের বহু পূর্ব থেকেই তারা শ্রুতিতে অহিংসার পক্ষে মত জ্ঞাপন করেন । অপরদিকে অশােক যে শূদ্রবংশ জাত ছিলেন এরূপ মতও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় না । প্রাচীন সাহিত্যে ও শিলালিপিতে অশােকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্তকে ক্ষত্রিয় বলেই অভিহিত করা হয়েছে । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও বলেন যে ,অশােক ধর্মমহামাত্রদের পদ সৃষ্টি করে প্রত্যক্ষভাবে ব্রাত্মণদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেন ।কারণ ধর্মমহামাত্রগণ ধর্ম বিষয়কে দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে সঙ্গে শাসনদায়িত্ব পালন করতেন । ব্রাক্ষ্মণদের প্রতি উদারতা প্রদর্শনও তাদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল । তবে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অশােকের বিরুদ্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উত্থাপিত অভিযােগ গুলােকে ভিত্তিহীন বলে মনে করেন ।
ডক্টর বেনীমাধব বড়ুয়ার মতে অশােকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার ফলে মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশােককে কোন ক্রমেই দায়ী করা যায় না । তিনি এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন খালদুনের উক্তিরও উল্লেখ করেন । উত্থান, উন্নতি এবং পতনই সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক পরিণতি এবং ১২০ বছরের মধ্যেই এই চক্রের পরিসমাপ্তি অনিবার্য । তাছাড়া তিনি বলেন যে , বৌদ্ধধর্মের মূল আদর্শকে তার রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করলেও তার উত্তরাধিকারীগণ তার এই নীতি অনুসরণ করেন নি । দশরথ শালিশুক এবং সম্প্রতি নিঃসন্দেহে অশােকের নীতি বর্জন করেন । দশরথ ছিলেন আজীবিকদের ভক্ত । যুগপুরাণ অনুযায়ী শালিশুক ছিলেন অত্যাচারী রাজা এবং সেজন্য তিনি সিংহাসন পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন । আর সম্প্রতি ছিলেন জৈনধর্মাবলম্বী । সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তারা ব্যক্তিগত জীবনে ও রাষ্ট্রপরিচালনার অশােকের নীতি অনুসরণ করেন নি ।
( ৫ ) উপসংহার - মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বােঝা যায় যে মৌর্য সাম্রাজ্যের অবনতি ও অবলুপ্তির মূল দায়িত্ব অশােকের নয়, অশােকের উত্তর পুরুষদের । অশােকের মৃত্যুর অল্পকাল পরেই মৌর্যসাম্রাজ্য দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে । ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের আক্রমণে পশ্চিমাংশের মৌর্য সাম্রাজ্য বারবার বিধ্বস্ত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার অবলুপ্তি আসন্ন হয়ে পড়ে । তাছাড়া মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে উন্নতি দেখা দিয়েছিল পরবর্তীকালে তা অনেকাংশেই বিনষ্ট হয় । মৌর্যযুগের শেষের দিকে মুদ্রাগুলাের নিকৃষ্টতা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করে । পরবর্তীকালের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিকৃষ্টতা এই মতের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় । সেজন্য অনেকে মনে করেন মৌর্য কোষাগারের এই অর্থনৈতিক সঙ্কট অসামরিক ও সামরিক শাসনব্যবস্থার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে সরকারের কর্মচারীদের মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয় । এঈ রূপ পরিস্থিতির সুযােগ নিয়েই পুষ্যমিত্রশুঙ্গ শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন ।