মুঘল যুগের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর মুঘল যুগের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও mughol juger bhumi rajoswo babosthar bornona dao


উত্তর : সমগ্র মুঘল আমলে বা সমগ্র সাম্রাজ্যে একধরনের রাজস্ব নীতি অবলম্বন করা হত না ।  পরবর্তীতে ইংরেজ সরকারও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় বৈচিত্র্যের তারতম্যানুসারে স্বতন্ত্র রাজস্ব ব্যবস্থা অনুসরণে বাধ্য হয়েছিল । আকবর প্রবর্তিত ‘দশালা’ ব্যবস্থা ভিন্ন অন্য ধরনের একটি ব্যবস্থা ছিল ‘গাল্লাবক্স’। এটা হল ফার্সী ভাষা , ভাণ চাষ অর্থে ব্যবহৃত হত । হিন্দী বা এই জাতীয় ভাষায় এই পদ্ধতি ‘বাতাই’ বা ‘ভাওয়ালী’ নামে পরিচিত ছিল । এই ব্যবস্থায় সরকার ও উৎপাদক উভয়েরই ঝুঁকির সম্ভাবনা ছিল কম । কারণ উৎপাদনে মন্দার সময় কৃষকেরা যেমন সরকারের সাথে ঝুঁকি ভাগ করে নিতে পারত । তেমনি বাজারে যখন শস্যের দাম চড়া পাওয়া যেত , তখন কর্তৃপক্ষের কাছে এটা লাভের ব্যাপার হত । এই ব্যবস্থা থুম্বা, কাবুল , কাশ্মীর - এর একাংশে প্রচলিত ছিল । 


মুঘল আমলে প্রচলিত রাজস্ব নির্ধারণের আর একটি সহজ পদ্ধতি হল ‘হস্ত ও - বুদ’ । এই পদ্ধতি ভারপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মচারী গ্রাম পরিদর্শন করতেন এবং ভালমন্দ দু'ধরনের জমির ফসল দেখে উৎপাদনের আনুমানিক হিসেব কষে রাজস্ব নির্ধারণ করতেন । আব্দুল নােমান আহম্মদ সিদ্দিকির মতে এটি রাজস্ব নির্ধারণের সর্বোচ্চ পদ্ধতি । কারণ এটি জমিদার ও রায়তদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করত । দক্ষিণ ভারতের আর একটি প্রচলিত ব্যবস্থা হল – লাঙল গুনতি । এই ব্যবস্থায় এলাকার কৃষকদের লাঙল গুনে লাঙল প্রতি রাজস্ব নির্ধারণ করা হত । এই ব্যবস্থাটি ছিল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক । 

তুলনামূলকভাবে আর একটি পদ্ধতি হল ‘কানকুত ’ বা ‘কানকুট ’ বা ‘দানাবন্দী’ ব্যবস্থা । এই পদ্ধতিতে নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় বাধ্যতামূলক ছিল না এবং প্রকৃত উৎপাদনানুসারে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত । শষ্যের ক্ষতি হলে কৃষক ও সরকার সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত । ডঃ সিদ্দিকীর মতে , কানকুট ব্যবস্থায় কৃষক জমিদারের কাছে বেশি শস্য ছিল । হাবিবের মতে শষ্য কাটা ঝাড়াই এর উপর কোন নজরদারী হত না , তাই প্রশাসনিক ব্যয় কম হত ।

 
আকবরের আমলে ‘নাসক ’ নামক রাজস্ব নির্ধারণ পদ্ধতিটি বাংলা, কাশ্মীর ও বেরাবে প্রযুক্ত হত । নসক শব্দটিকে সরকারী নথিতে জবত এলাকায় বার্ষিক জরিপের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে । 


বেরারে লাঙলের সংখ্যার ভিত্তিতে , বাংলায় জমিদারদের দীর্ঘ প্রচলিত ধার্য রাজস্ব ভিত্তিতে এবং কাশ্মীরে সম্ভবত শষ্য উৎপাদনের ভিত্তিতে একবার  রাজস্ব বেঁধে দেওয়ার পর বছরের বছর আদায় করা হত । ‘নসক’ এর বিভিন্ন রূপের বৈচিত্র্যের  মধ্যে একটাই মূল বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে । তাহল প্রতি বছর নতুন করে আংশিক বা সম্পূর্ণ রাজস্ব নির্ধারণ করা হত । একবার নির্ধারণ করা হলে বছরের পর বছর পুনরাবৃত্ত করতে হত । ‘আমল -ই - খােওয়াত’ ‘আমল -ই -জিনসি’ ‘সরবস্তা’ ‘তসখিস - ই -নকসি’ ইত্যাদি কয়েকধরনের রাজস্ব নির্ধারণ ব্যবস্থা মুঘল যুগে প্রচলিত ছিল । তবে এগুলির প্রয়ােগ ছিল খুবই কম । 


সাধারণ ভাবে বলা যায় , মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলে ‘জবত’ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং নগদ টাকায় রাজস্ব আদায় করা হত । নসক ও অন্যান্য এলাকায় কিছুটা শষ্য ও বাকীটা অর্থে আদায় করা হত । হাবিবের মতে , নগদ সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত উন্নত ব্যবসায়িক সমাজ অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে । আবুল ফজল লিখেছেন , “আকবর জমি দখল করার জন্য রাজস্ব দাবী করতেন না । রাজস্ব দাবী করতেন জমি উৎপাদন ফসল ভােগ করার জন্য ।” সম্ভবত এই কারণে ইউরােপের মত ভারতবর্ষে ভূমিদাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়নি । তবে কৃষক নিজের ইচ্ছামত জমি ছেড়ে যেতে পারত না তাই তাকে পূর্ণ স্বাধীন বলা যাবে না । 

 
সমগ্র মুঘল যুগে সাধারণভাবে ‘নসক’ মুদ্রায়/প্রথায় রাজস্ব আদায় করা হত । কানক্ট ও ভাওয়ালী শস্যের মাপের রাজস্ব নির্ধারিত হলেও নগদ মুদ্রায় রাজস্ব প্রদানের ব্যাপারে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা করা হয় । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব নীতিতে কৃষিকাজ উৎসাহিত করার জন্য নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় - 

১ । প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য উৎপাদন হ্রাস হবার জন্য রাজস্ব ছাড় দেওয়া । 

২ । অভাবগ্রস্ত চাষীকে তকাব / তকবী বা কৃষিঋণ দেওয়া । 


৩। যে জমিতে নতুন আবাদ করা হত সেখানে প্রচলিত রাজস্বের থেকে কম রাজস্ব নেওয়া ।  

৪। সাধারণ ভােগ্য শষ্যের ( ধান , গম , বাজরা ) পরিবর্তে অর্থকরী শস্য ( তুলা,পাট ) আবাদ করলে কম হারে রাজস্ব নেওয়া । 


৫। অব্যবহৃত কূপ সংস্কার করলে সেই চাষীকে সেই বছরের জন্য ভূমি রাজস্ব প্রদান থেকে রেহাই নেওয়া । 

 

কার্ল মার্কস ১৮৫৩ খ্রিঃ প্রকাশিত তার একটি প্রবন্ধে এই কাজের জন্য মুঘল শাসকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । যাইহােক মােটামুটি একথা স্বীকার করা যায় যে, মুঘলদের কৃষিনীতি তথা ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা মধ্যযুগীয় সীমাবদ্ধতার বিষয়ে গঠনমূলক ছিল । 
 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন