১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি ভারতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে মনে করাে ?

Clg history questions answers কলেজ প্রশ্নোত্তর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি ভারতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে মনে করাে ১৮৫৭ khirstabder bidroher ki bharate prothom swadhinota judho bole mone koro


উত্তর : ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্বন্ধে আজও ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । কারও কারও মতে এটা ছিল একটি ‘মিউটিনি’ অর্থাৎ সিপাহিদের বিদ্রোহ মাত্র , আবার কেউ কেউ একে জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন , আবার কারও মতে এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয় । 

জাতীয় সংগ্রাম না , ‘সিপাহীদের বিদ্রোহ’ : জে বি  নর্টন, ম্যালেসন , ডক্টর ডাফ প্রমুখ মুষ্টিমেয় ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হলেও কালক্রমে উহা জাতীয় আন্দোলনের প্রকৃতি লাভ করেছিল , কিন্তু চার্লস রেকস্ নামক সামরিক ইংরেজ বিচারপতি , ঐতিহাসিক জন কে প্রমুখ অধিকাংশ লেখকদের মতে এটা সিপাহীদের বিদ্রোহ ছাড়া কিছুই ছিল না । স্যার সৈয়দ আহম্মদ , বাঙালি সামরিক কর্মচারী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সমসাময়িক কয়েকজন ভারতীয়দের লেখায় শেষােক্ত মত সমর্থিত হয়েছে । 


ভারতের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ : ভারতীয় বিপ্লবী বিনায়ক দামােদর সাভারকর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের লন্ডনে ‘The Indian war of Indepence ' গ্রন্থে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন । পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক সুশােভন সরকার এই মতকে সমর্তন করেছিলেন , তাঁর মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ না বললে ইটালির কার্বোনারী আন্দোলনকে ইটালির মুক্তি সংগ্রাম বলে অভিহিত করা যাবে না । অনুরূপভাবে নেপােলিয়নের বিরুদ্ধে রুশ কৃষকদের যুদ্ধকেও জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করা যাবে না । ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘The Sepoy Mutinx and the Revolt of 1857’ গ্রন্থে চার্লস রেকস - এর মতামত গ্রহণ করে বলেছিলেন যে ,এই বিদ্রোহের কোনাে একটি বিশিষ্ট রূপ ছিল না , ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ইহা ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছিল , ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন তার ‘Eighteen fifty seven' গ্রন্থে প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বলেছিলেন যে,১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সিপাহিদের বিদ্রোহ রূপেই শুরু হয়েছিল , তবে সর্বত্রই উহা সিপাহীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, স্থানে স্থানে জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেছিল । তাই বলে এই বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রামের পর্যায়ে উন্নীত করা যায় না । 

 
বিপক্ষে যুক্তি : ড . মজুমদার বিভিন্ন যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না । কারণ 

প্রথমত । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতবাসীর প্রথম ব্রিটিশ-বিরােধী বিদ্রোহ বলা যায় না । উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ও গণ -বিক্ষোভ সংগঠিত হয় । 

দ্বিতীয়ত । ১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহ সর্বভারতীয় বিস্তৃতি লাভ করেনি । এই বিদ্রোহ মূলত উত্তরপ্রদেশ , দিল্লি , বাংলা ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে সীমাবদ্ধ ছিল । 


তৃতীয়ত । শিখ , রাজপূত , মারাঠা , গােখা প্রভৃতি জাতিসমূহ এই বিদ্রোহে কোনাে অংশগ্রহণ করেনি । শুধু তাই নয় , শিখ ও গােখগণ ব্রিটিশ পক্ষ অবলম্বন করেছিল । শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এই বিদ্রোহের বিপক্ষে মনােভাব পােষণ করেছিল । 


চতুর্থত । বিদ্রোহের নেতারা জাতীয়বাদী আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেননি । তারা নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন । 


পঞ্চমত । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবােধের আদর্শ পরিস্ফুট হয়নি । তাই এই বিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যুক্তিযুক্ত নয় । ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছেন  – “It is difficult to avoid the conclusion that the so -called First National war of independence of 1857 in neither the First , nor National , nor a war of Independence .” 

 
ব্যাখ্যার ত্রুটি : অনেকে বলেন যে , সারা দেশ জুড়ে এক বিক্ষোভ দেশবাসীকে বিচলিত করে তুলেছিল এবং সিপাহীদের মধ্যে কয়েকটি গুরুতর কারণে সে বিক্ষোভ তীব্র হয়েছিল । সেই যুগের পরিস্থিতিতে ব্রিটিশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম ছিল একমাত্র সামরিক শক্তি । সেইজন্য সৈন্যবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়েছিল । কৃষকদের বিক্ষোভও দেখা দিয়েছিল । সে যুগের পরিস্থিতিতে প্রকৃত জাতীয় অভ্যুত্থান পুরােপুরি সম্ভব ছিল না । তাই তারা মনে করেন যে , ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মধ্যে প্রখর জাতীয়তার লক্ষণ খুঁজতে পাওয়া যেমন ভুল , তেমনি জাতীয়তাবাদের চিহ্নমাত্র খুঁজে না পাওয়াও ভুল । 


গণবিদ্রোহ : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ব্যাপক অভ্যুত্থানকে কেবলমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ রূপে ব্যাখ্যা করলে এর সঠিক মূল্যায়ন করা হবে না । যদিও ইহা প্রথমে সিপাহী বিদ্রোহ রূপে আরম্ভ হয়েছিল সত্য , কিন্তু পরে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের ব্যাপক অঞ্চলে এক গণ -বিদ্রোহের চরিত্র ধারণ করেছিল । অযােধ্যায় ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে যে দেড় লক্ষ লােক প্রাণ হারিয়েছিল তার মধ্যে প্রায় এক লক্ষ লােক ছিলেন বে - সামরিক । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ নিঃসন্দেহে এক জাতীয় সংগ্রামের চরিত্র ধারণ করেছিল । যে অর্থে নেপােলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনের উপদ্বীপের যুদ্ধ অথবা রাশিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধ ছিল মুক্তি-সংগ্রাম সেই অর্থেই ব্রিটিশ-বিরােধী এই ব্যাপক গণবিদ্রোহ ছিল জাতীয় বিদ্রোহ । কার্ল মার্কস ‘ভারতীয় বিদ্রোহ’ ‘ভারতীয় প্রশ্ন’ প্রভৃতি প্রবন্ধে লিখেছেন যে , সিপাহীরা ছিল খণ্ডমাত্র, মূলত কৃষকেরা ১৮৫৭ - র বিদ্রোহের প্রধান পরিচালিকা শক্তি । মার্কসের অভিমত ছিল এই যে ১৮৫৭ বিদ্রোহ ছিল ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম । ভারতের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সকলেই বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিল । 

 
উপসংহার : একথা সত্য যে , ১৮৫৭ - র মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যপূরণে সফলতা পায়নি । কিন্তু ভবিষ্যতে এই মহাবিদ্রোহ ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের আদর্শ ও উদ্দীপনা সঞ্চারিত করেছিল । তাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সফল না হলেও মহাবিদ্রোহের স্মৃতি ও আদর্শ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে বেশি ক্ষতিকারক হয়েছিল ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন