বক্সারের যুদ্ধের কারণ আলােচনা কর ।

Clg history questions answers কলেজ প্রশ্নোত্তর বক্সারের যুদ্ধের কারণ আলােচনা কর boxarer judher karon alochona koro


উত্তর : ইংরেজ কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে গােপন চুক্তির মাধ্যমে সিংহাসনে বসলেও মিরকাশিম ছিলেন স্বাধীনচেতা পুরুষ । সুদক্ষ শাসক ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ । সিংহাসন আরােহনের পূর্বে তিনি রংপুর ও পূর্ণিয়ার ‘নায়েব - দেওয়ান’ ছিলেন এবং দক্ষতার সঙ্গেই সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন । তার সঙ্গে বিভিন্ন কারণে ইংরজেদের বিরােধ বাঁধে । 

স্বাধীনচেতা নবাব মিরকাশীম ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে রাজি ছিলেন না । তিনি বার্ষিক ২৫ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার করে মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে নবাবি ‘ফরমান’ আনেন এবং এর দ্বারা তিনি দিল্লির বাদশাহের অধীনে আইনসম্মত নবাবে পরিণত হন । ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল কর্মচারীদের বিতাড়িত করে তিনি নিজ শাসনকে সুদৃঢ় করেন । মুর্শিদাবাদ কলকাতার খুব কাছে হওয়ায় দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনায় সেখানে কোম্পানির হস্তক্ষেপ অতি সহজ ছিল । তাই ‘ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । বলা হয় যে ,নবাব তার নিজের নৌবাহিনী দুর্বলতা এবং ইংরেজ নৌবাহিনীর দক্ষতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন । তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে , নদী - তীরবর্তী  অঞ্চলে অবস্থান করে দুর্বল নৌবাহিনী নিয়ে শক্তিশালী ইংরেজদের সঙ্গে পারা যাবে না । এই কারণে তিনি নদী বা সমুদ্র থেকে দূরে মুঙ্গেরে নিজ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । 
অধ্যাপক পি . জে মার্শাল বলেন , পূর্ব ভারতে স্বাধীন নবাবী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েই তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন । তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর গুরুত্ব বুঝতেন । এই কারণে তিনি সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন । মােগল রণকৌশলের পরিবর্তে তিনি ইওরােপীয় রণকৌশল গ্রহণ করেন । উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের দুর্ধর্ষ তাতার , আফগান ও পারসিক এবং কিছু আর্মেনিয়ান্দে সেনাদলে গ্রহণ করা হয় । অশ্বারােহী বাহিনী পরিচালনায় মােগল সেনাপতিরা থাকলেও পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্ব ইওরােপীয় সেনাপতির ওপর অর্পিত হয় । কলকাতার আর্মেনীয় বণিক খোঁজা পিদ্রুর ভাই গােত্মরগরী তার প্রধান সেনাপতি ও গােলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন ।ফরাসি সমরু বেং আর্মেনীয় মার্কার, জেন্টিল প্রমুখ তার অন্যান্য সেনাপতি নিযুক্ত হন । মুঙ্গেরের পুরানাে দুর্গগুলির সংস্কার করা হয় । মুঙ্গেরে তিনি একটি কামান বন্দুক ও গােলা - বারুদের কারখানা স্থাপন করেন । বলাবাহুল্য, ইংরেজদের পক্ষে মিরকাশিমের এই সকল কার্যকলাপ সহ্য করা সম্ভব ছিল না । অচিরেই কোম্পানির বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার নিয়ে দু’পক্ষে সশস্ত্র সংঘর্ষ দেখা যায় ।  

১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মােগল সম্রাট ফারুখশিয়র প্রদত্ত ‘ফরমান ’ অনুযায়ী কোম্পানি বাংলাদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে । এই অধিকার কোম্পানিকেই দেওয়া হয় — কোম্পানির কর্মচারী এবং তাদের অনুগৃহীত ভারতীয় বণিকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জন্য ও ‘দস্তক’ বা এই ছাড়পত্রের অপব্যবহার করত । এর ফলে একদিকে নবাব যেমন তার বৈধ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতেন , তেমনি অপর দিকে ভারতীয় বণিকেরা এই অসম প্রতিযােগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হতাে । এছাড়া কোম্পানির কর্মচারীরা নবাবরে কর্মচারী ও জমিদারদের কাছ থেকে নানাভাবে উৎকোচ এবং নজরানা আদায় করতে শুরু করে । নবাবের একচেটিয়া বাণিজ্য যথা লবণ , সােরা প্রভৃতিতে তারা অংশ নিতে থাকে এবং গ্রামে- গঞ্জে ঢুকে পড়ে তারা সুপারি , চাল , ঘি , মাছ , চিনি , বাঁশ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবসা শুরু করে । তারা দেশীয় কারিগর ও বণিকদের ভয় দেখিয়ে ইংরেজদের কাছে সস্তায় মাল বিক্রি করতে বাধ্য করত এবং ইংরেজদের পণ্যাদি চার পাঁচ গুণ বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করত । ইংরেজ ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এই যুগকে ‘প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন । 
এইসব কারণে বাংলার অবস্থা জটিলতর রূপ ধারণ করে , দেশীয় বণিকরা শুল্ক না দেবার জন্য নানা ছল -চাতুরির পথ ধরে , বহুক্ষেত্রে চাষি ও উৎপাদকরা চাষ -বাস ও উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং বহুস্থানে দেশীয় উৎপাদক , ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাষিরা কোম্পানির কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে । এর ফলে আইন - শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে । 

ভেরেলেস্ট - এর মতে , দস্তকের অপব্যবহার বা অব্যন্তরীণ বাণিজ্য নয় মিরকাশীম - এর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাই এই সংঘর্ষের জন্য দায়ী । এই বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে ইংরেজ ঐতিহাসিক ডডওয়েল বলেন , মিরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের বিরােধ কোম্পানির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটনাচক্রে সংঘটিত হয় । তিনি বলেন , অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রশ্ন যুদ্ধের প্রকৃত কারণ নয় , যুদ্ধের একটি চমৎকার অজুহাত মাত্র মিরকাশিমের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ইংরেজদের প্রাধান্য মুক্ত হওয়া । কেম্বুিজ ঐতিহাসিক পি . জে মার্সাল বলেন যে , মিরকাশিম বাংলাদেশে ইংরেজদের শক্তিবৃদ্ধি সুনজরে দেখেননি । 

অতপর ইংরেজ সেনাপতি মেজর অ্যাডমাস মিরকাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন । কাটোয়া , গিরিয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে পর পর পরাজিত হয়ে হয়ে মিরকাশিম অযােধ্যায় পলায়ন করেন । সেখানে অযােধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে এই সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মনরাে - র হাতে পরাজিত হয় । বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ আধিপত্য এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং মিরকাশিমের সকল আশা নির্মূল হয় । মিরকাশিমের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় প্রকৃত স্বাধীন নবাবির অবসান ঘটে । পলাতক অবস্থায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন