উত্তর : মােঘল সাম্রাজ্যের পতনকে দুইভাবে বােঝবার চেষ্টা করা হয়েছে । একটি হয়েছে বাক্তিকেন্দ্রীক সুকৃতি - দুস্কৃতি, যােগ্যতা-অযােগ্যতা , কৃতিত্ব ও অকৃতিত্ব । ভিনসেন্ট স্মিথ, লেনপুল কিং , আরভিন ,যদুনাথ সরকার , কুরেশী, এস.আর.শর্মা প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ - যাঁরা সবাই পুরানাে দিনের ঐতিহাসিক — তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ঔরঙ্গজেবের মতাে শাসকেরা যে কর্মক্ষমতা দেখিয়েছিলেন তা আর পরবর্তী শাসকদের মধ্যে দেখা যায় নি । স্যার যদুনাথ সরকার এর মতে , – “ ঔরঙ্গজেব ছিলেন প্রথম প্রতিভাবান মুঘল সম্রাট। ” আবার তিনিই লিখেছেন “ যে সাম্রাজ্য নানা জাতি ও ধর্ম, বিচিত্র স্বার্থ ও জীবনবােধ ও চিন্তা নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই সাম্রাজ্যে ঔরঙ্গজেব ছিলেন নিকৃষ্ট সম্রাট, যাকে কল্পনা করা যায় ।” ঔরঙ্গজেবকে নিকৃষ্ট বলা হয়েছে । কারণ ,তার প্রবল ধর্মান্ধ সুন্নীনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ অ -মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল এবং তার ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের মানবিক বনিয়াদ নষ্ট হয়েছিল ।
এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক পূর্ব প্রজন্মের ঐতিহাসিদের মতকে সরিয়ে দিয়ে বিগত প্রায় চার দশক ধরে ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংস হওয়ার ঘটনাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । উপরােল্লিখিত মতটির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে এই বােধ থেকে , ইতিহাসের প্রকৃত চালিকা শক্তি ব্যক্তি মানুষ নয় বরং যুথবদ্ধ মানুষ , সমষ্টিবদ্ধ মানবতার প্রতিষ্ঠান । পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ আর্থ সামাজিক সমস্যাগুলির উন্মােচন ঘটাতে পেরেছেন । তাদের মত হলাে - মুঘল সাম্রাজ্যের বিনাশের দ্বিতীয় মত হল আর্থ সামাজিক মত । মুঘল সাম্রাজ্যের পতন কোনাে আকস্মিক ঘটনা নয় , সম্পদের বিষম বন্টন , জায়গীরদার এর মতাে চক্রান্ত আরও প্রতিযােগিতার সৃষ্টি করে । তবে জায়গীরদার - এ শােষণ ও কৃষক নিপীড়ন কৃষক বিদ্রোহের কারণ হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পরে সেখানকার জায়গীরদার ও সম্পদের সুষ্ঠ বিতরণ বিষয়ে ঔরঙ্গজেবের অক্ষমতা সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের বিনষ্ট করেছিল ।
মুঘল দরবারে দল ব্যবস্থা, দলীয় কোন্দল এবং সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে মুদ্রা মূল্যের হ্রাস ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিবেশে নিরবিচ্ছিন্ন ও অধােগামী দল ও উপদলের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের দৃপ্ত কাঠামােকে অসার করেছিল । শেষ পর্বে ঔরঙ্গজেবের সময় থেকেই মুঘল অনুসৃত রাজপুত নীতির ফল হয়েছিল এই যে , মুঘল দরবারে ও সম্রান্ত শ্রেণির আয়তনের মধ্যে রাজপুতরা ক্রমশঃ প্রান্তিক হয়ে আসছিল ।
মুঘলদের উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত নীতির ফলে আফগানরাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল । এইভাবে সাম্রাজ্য প্রতিরক্ষায় আফগান ও রাজপুত এই দুই যােদ্ধা জাতি ক্রমশঃ প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার ঘটনা মুঘল সাম্রাজ্যকে দুর্বল করেছিল । ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের সময় দেখা গিয়েছিল , আফগান -রাজপুতদের প্রাপ্তি হওয়ায় বিষময় ফল সেখানে নিরন্তর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসা মুঘল বাহিনীকে পুনরায় শক্তি যােগানের মতাে নতুন কোনাে সামরিক মানব সম্পদের সঞ্চয় মুঘলদের আর ছিল না । এই পরিবেশেই দুর্দান্তভাবে আত্মপ্রকাশ হয়ে পড়েছিল শিখ , সৎনামীদের বিদ্রোহ । আবার তখনই দেখা গেছে যে , মুঘল শাসক শিবিরে ঔরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ আকবরের মতাে শাসন ক্ষমতা সর্বোচ্চ দাবীদারের বিদ্রোহ , যা শাসক শিবিবের অনৈক্যকে প্রতিপন্ন করেছিল ।
ভাবতে অবাক লাগে যে , ঔরঙ্গজেবের সময় মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বড়াে আয়তন ও সবচেয়ে বেশি রাজস্ব ও রসদের অধিকার ছিল ; অথচ সেই সময়েই কি নেতৃত্বের পর্যায়ে, কি আরও নীচের স্তরে মুঘল সাম্রাজ্য মানব শক্তি সঞ্চারনের ক্ষমতা হারিয়েছিল ।