সংক্ষেপে চোলরাজ রাজরাজের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর সংক্ষেপে চোলরাজ রাজরাজের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর songkhepe cholraj rajrajer jiboni o krititto alochona koro questions answers


উত্তর : রাজরাজ : চোলরাজ সুন্দর চোলের মৃত্যুর পর তার পুত্ররাজরাজ ( ৯৮৫ -১০১৪ খ্রিস্টাব্দ ) সিংহাসনে বসেন । চোলরাজবংশের মহিমা বৃদ্ধি করে তিনি ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । রাজরাজ ছিলেন চোলরাজবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি । তিনি একটি আঞ্চলিক রাজ্যকে শাসনতান্ত্রিক দক্ষতা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সামরিক প্রতিভার দ্বারা একটি সুসংগঠিত , সমৃদ্ধ , সুশাসিত , বিস্তৃত , নৌ ও স্থলশক্তিতে সমভাবে পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ।
 


( ২ ) রাজ্য জয় : রাজারাজ চোলের তাম্র শিলালিপি থেকে তার সামরিক কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় । পাণ্ড্য কেরল ও সিংহলের রাজাদের মধ্যে গঠিত সামরিক জোট আক্রমণ করে রাজরাজ তার বিজয় অভিযান শুরু করেন । পরপর দুবার অভিযান প্রেরণ করে তিনি পাণ্ড্যদের দমন করেন । তিনি মাদুরা জয় করে পাণ্ড্যরাজ অমরভূজঙ্গ পাণ্ড্যকে বন্দী করেন । তিনি পাণ্ড্য ও কেরলের সামরিক শক্তি হ্রাস করার উদ্দেশ্যে কুদমালাইনডু অর্থাৎ কুর্গ ও উদগাই এর দুর্গ অধিকার করেন । পাণ্ড্যরাজ্য জয় করা পর তিনি কেরলের দিকে অগ্রসর হন । কান্ডালুর ও ভিলিগ্রাম জয় করে তিনি কেরল জয় করেন । পাণ্ড্য ও কেরল জয় করার পর রাজরাজ সিংহল ( শ্রীলঙ্কা ) আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন । সিংহলের বিরুদ্ধে তিনি একটি বিরাট শক্তিশালী নৌবাহিনী পাঠান । তিনি সিংহলের উত্তরাংশ জয় করেন এবং সিংহলের রাজা পঞ্চম মহীন্দ্র আত্মরক্ষার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব সিংহলের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন । আক্রমণকারীরা অনুরাধাপুর অধিকার করে এবং চোলদের অধিকৃত উত্তর সিংহলের রাজধানী পােলােন্নারুভ নগরীতে স্থাপিত হয় । চোলদের সিংহল বিজয়ের পর রাজরাজ অনুরাধাপুরে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেন ।

পাণ্ড্য, কেরল ও সিংহল রাজ্যের কতক অংশ জয় করেই রাজরাজ সন্তুষ্ট হতে পারেননি । তিনি মহাশূর   অর্থাৎ বর্তমান কর্ণাটকের বিরুদ্ধেও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন । মহাশূরের গঙ্গারাজ্যের পশ্চিম দিকের সীমানার কয়েকটি অঞ্চল ৯৯১ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রাজরাজ জয় করেন । তারপর একশতাব্দী পর্যন্ত ঐসব অঞ্চলের ওপর চোলদের কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে । কিন্তু মহীশূরের দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলেই চালুক্যরাজবংশের সঙ্গে চোলরাজবংশের সংঘর্ষের সূচনা হয় । এই সময় চালুক্যরাজ ছিলেন দ্বিতীয় তৈল । ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয় । কিন্তু চোল চালুকোর সংঘর্ষের প্রথম দিকের ফলাফল চোলদের অনুকূলে না যাওয়ায় চালুক্যদের সাহস আরও বেড়ে যায় । বিশেষত দ্বিতীয় তৈলের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সত্যাশ্রয় ছিলেন চোল শক্তির প্রধান শত্রু । ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণের পর চালুক্যদের প্রভাব অব্যাহত রাখার জন্য তিনি বিশেষ সর্তক দৃষ্টি দিতে শুরু করেন । দক্ষিণাপথের পূর্বদিকে চোলদের ক্ষমতা বিস্তারের স্পর্ধা সহ্য করতে অসমর্থ হয়ে পশ্চিমাঞ্চলের চালুক্যরাজ্যের অধিপতি সত্যাশ্রয় ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে চোলদের আশ্রিত বেঙ্গীরাজ্য আক্রমণ করেন । এই সময় বেঙ্গির সিংহাসনে ছিলেন রাজরাজ চোলের অনুগত নরপতি শক্তিবর্মন । চালুক্যরাজ সত্যাশ্রয়ের সেনাপতি রায়লনম্বী ধান্যকটক সহ কয়েকটি শক্তিশালী দুর্গ অধিকার করে গুন্টুর জেলায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন । রাজনৈতিক পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে রাজরাজ আত্মরক্ষার প্রকৃষ্ট উপায় হিসাবে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন । ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার পুত্র রাজেন্দ্র চোলকে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে পশ্চিম চালুক্য রাজ্য আক্রমণ করতে নির্দেশ দেন । তিনি রাজধানী বনবাসী অধিকার করেন । রায়চুয়ের দোয়াব অঞলের অধিকাংশ তার পদানত হয় । মাল্যখেতও তার দ্বারা লুণ্ঠিত হয় । ঠিক এই সময় চোলদের অপর একটি সৈন্যবাহিনী বেঙ্গি থেকে যাত্রা করে হায়দ্রাবাদের ৪৫ মাইল উত্তর পশ্চিমের অবস্থিত কোল্লিপাই অর্থাৎ বর্তমান কুলপক পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানকার দুর্গটি অধিকার করে । এইরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সত্যাশ্রয় বেঙ্গি থেকে সৈন্য অপসারিত করতে বাধ্য হন এবং নিজের রাজ্য থেকে চোলদের বহিষ্কৃত করতে সমর্থ হন । সত্যাশ্রয়ের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে চোল সৈন্যগণ চালুক্যরাজ্য নির্বিচারে লুণ্ঠন করে তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ দিকে আশ্রয় নেয় । 


রাজত্বের শেষদিকে রাজরাজ মালদ্বীপ জয় করে চোলসাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন । ফলে ভারতের পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে অবস্থিত অধিকাংশ দ্বীপের ওপরই চোলদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় । 

রাজরাজ কর্তৃক সিংহল ও মালদ্বীপ অধিকারের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির উদ্দেশ্য দ্বারা প্রনােদিত নয়, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ রাজরাজ এই দুটি দ্বীপ অধিকার করে ভারত মহাসাগর ও আরবসাগরে আরব বণিকদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ধ্বংস করার চেষ্টা করেন । রাজরাজ ভারত ও পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে আরব বণিকদের অনুপ্রবেশের বাস্তব উপলদ্ধি করেই এই দুটি স্থানে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে উৎসাহী হন । সিংহল ও মালদ্বীপ ছিল আরব বণিকদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল । সুতরাং এই দুটি স্থান নিজের অধিকারে আনয়ন করে একদিকে ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে এবং অপরদিকে আরব বণিকদের অগ্রগতি রােধ করার জন্য তিনি চেষ্টা করেন । দক্ষিণ ভারতের সৈকতভূমির নিরাপত্তাবৃদ্ধির জন্য রাজরাজ নৌবাহিনী শক্তিশালী গড়ে তােলার জন্য এক ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন ।



( ৩ ) কৃতিত্ব : রাজরাজ চোল নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন । তিনি দক্ষ প্রশাসক , ধার্মিক এবং পরধর্ম সম্পর্কে উদার মত পােষণ করতেন । সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি তিনি অনুরাগী ছিলেন । মধুর ব্যবহারের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । শুধু রাজ্য জয় করেই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি , বিজিত অঞ্চলের শাসনব্যবস্থার প্রতিও তিনি সর্তক দৃষ্টি দিতেন । ভূমি সংস্কার এবং সঠিক রাজস্ব নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজ্যের সমস্ত জমি জরীপ করার ব্যবস্থা করেন । অপর দিকে চোলদের প্রচলিত স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকেও তিনি আরও উন্নত করে তােলার চেষ্টা করেন । এক ব্যক্তির মধ্যে বহুগুণের সমাবেশের জন্য তার মহামতি আখ্যা সার্থক হয়েছে । 



রাজরাজ শৈবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন । তবে পরধর্মমত সম্পর্কে তিনি উদার মনােভাব পােষণ করতেন । স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপােষক রাজরাজ চোল তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর শিব মন্দির নির্মাণ করেন । এই মন্দির তামিল স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান কীর্তি বলে বিবেচিত হয় । পরধর্ম মত সহিষ্ণু রাজরাজ বিষ্ণু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার নির্মাণেও উৎসাহ দিতে দ্বিধা করেননি । রাজরাজের উৎসাহে শ্রীবিজয়ের শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা বিজয়ােতুঙ্গবর্মন নেগাপতমে একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন । সেযুগে এই বৌদ্ধ বিহারটি অন্যতম দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয় ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন