উত্তর : ( ১ ) ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার : পালরাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গােপালের মৃত্যুর পর আনুমানিক ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে আরােহণ করেন । ধর্মপাল বীর , সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নরপতি ছিলেন । সিংহাসনে আরােহণের পরই তিনি আর্যাবর্তে সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য চেষ্টা করেন । এই ব্যাপারে আর্যাবর্তে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রতীহাররাজ বৎসরাজ এবং তাঁর পুত্র নাগভট । দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব ও তাঁর পুত্র তৃতীয় গােবিন্দও এই সময় উত্তর ভারতের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করে ধর্মপালের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে বাধার সৃষ্টি করেন ।
সিংহাসনে আরােহণের কিছু দিন পরেই ধর্মপাল বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম দিকে বিজয় অভিযানে যাত্রা করেন । কিন্তু এই সময় বৎসরাজ সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য পূর্বদিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হয় এবং এই সংঘর্ষে ধর্মপাল পরাজিত হন । কিন্তু ধর্মপালের সৌভাগ্যবশত এই সময় রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব আর্যাবর্তে বিজয় অভিযান করে বৎসরাজকে পরাজিত করেন এবং পরাজিত প্রতিহাররাজ মরুভূমি অঞ্চলে আত্মগােপন করেন । ধ্রুব ধর্মপালকেও যুদ্ধে পরাজিত করেন । কিন্তু এই পরাজয়ের ফলে ধর্মপালের বিশেষ ক্ষতি না হওয়ায় এবং বৎসরাজের শক্তি প্রচন্ডভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রকূটরাজের দক্ষিণ ভারতে প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পরেই ধর্মপাল পুনরায় তাঁর বিজয় অভিযান শুরু করেন ।
ধর্মপালের রাজ্য জয় : ধর্মপালের পুত্র দেবপালের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল দিগ্বিজয়ে প্রবৃত্ত হয়ে কেদার ও গােকর্ণ এই দুই তীর্থ ও গঙ্গাসাগরসঙ্গম দর্শন করেন । কেদার ও গােকর্ণের অবস্থিতি সম্পর্কে কোন প্রকার মতবিরােধ না থাকলেও গঙ্গাসাগরসঙ্গমের অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিশেষ মতবিরােধ দেখা যায় । তবে গঙ্গাসাগরের অবস্থান নিয়ে যতই মতবিরােধ থাকুক না কেন ধর্মপালের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয়ে বের হয়ে পাঞ্জাবের প্রান্ত পর্যন্ত যে অগ্রসর হয় তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে । অনেকে মনে করেন যে এই সময় নেপালেও ধর্মপালের আধিপত্য বিস্তৃত হয় । দিগ্বিজয়ের প্রথম দিকেই তিনি ইন্দ্ররাজ বা ইন্দ্রায়ুধ এবং অন্যান্য রাজাদের পরাজিত করে কনৌজ ( কান্যকুজ ) পর্যন্ত অধিকার করেন । কান্যকুজ অধিকার করার পর তিনি সিন্ধুনদ ও পাঞ্জাবের উত্তরের হিমালয়ের পাদভূমি পর্যন্ত জয় করেন । দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে সম্ভবত তিনি কিছু দূর অগ্রসর হন । এইভাবে আযাবর্তের সার্বভৌমত্ব লাভ করে তিনি প্রকাশ্যে তা ঘােষণা করার জন্য কান্যকুজে এক বৃহৎ রাজ্যাভিষেকের দরবার আহবান করেন । এই রাজদরবারে আর্যাবর্তের বহু রাজা উপস্থিত হয়ে ধর্মপালের অধিরাজত্ব স্বীকার করেন । মালদহের নিকট খালিমপুরে প্রাপ্ত ধর্মপালের একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে , ভােজ , মদ্র, কুরু, কীর , যদু, যবন অবতী , গান্ধার প্রভৃতি জনপদের নরপালগণ ধর্মপালের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং রাজচক্রবর্তী বলে সসম্রমে অভিবাদন করেন । এই সব রাজ্যের মধ্যে গান্ধার , মদ্র, কুরু ও কীর দেশ যথাক্রমে পঞ্চনদের পশ্চিম , মধ্য , পূর্ব ও উত্তরভাগে অবস্থিত ছিল । যবনদেশ সম্ভবত সিন্ধুনদের তীরবর্তী মুসলমানদের অধিকৃত কোন রাজ্যের নাম । অবন্তী, মালবে এবং মৎস্যরাজ্য রাজপুতানার জয়পুর ও আলােয়ার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল । ভােজ ও যদুরাজ্যের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না । সম্ভবত ভােজরাজ্য বর্তমান বেরারে এবং যদুরাজ্য পাঞ্জাবে অবস্থিত ছিল । এইসকল রাজ্যের অবস্থিতি আলােচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে ধর্মপাল প্রায় সমগ্র আর্যাবর্তের অধীশ্বর ছিলেন । পালরাজাদের প্রশস্তি ব্যতীত অন্যত্রও ধর্মপালের এই সার্বভৌমত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় । একাদশ শতাব্দীতে সােডঢল রচিত ‘উদয়সুন্দরীকথা’ নামক চম্পুকাব্যে ধর্মপাল ‘উত্তরপথস্বামী’ বলে অভিহিত হন ।
এই বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে বাংলাদেশ ও বিহার ধর্মপালের নিজের শাসনাধীনে ছিল । অন্যান্য পরাজিত রাজারা ধর্মপালের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিজ নিজ রাজ্য শাসন করতেন । শুধুমাত্র কান্যকুজের পরাজিত রাজা ইন্দ্ররাজ বা ইন্দ্রায়ুধের পরিবর্তে চক্ৰায়ুধ নামক এক ব্যক্তিকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন । কিন্তু ধর্মপালের পক্ষে নিরুদ্বেগে এই বিশাল রাজ্য ভােগ করা সম্ভব হয় নি । তাঁর পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীহারবংশীয় বৎসরাজের পুত্র নাগভট ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং প্রথমে তিনি চক্ৰায়ুধকে পরাজিত করেন । নাগভটের কাছে ধর্মপালের সৈন্যবাহিনী সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হন । কিন্তু এবারও রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গােবিন্দ আর্যাবর্তে প্রবেশ করে নাগভটকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন । কিন্তু কিছু দিন পরেই তিনি দাক্ষিণাত্যে প্রত্যাবর্তন করেন । নাগভট এই যুদ্ধে এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে তার পক্ষে ধর্মপালের বিরােধিতা করা সম্ভব ছিল না । ফলে ধর্মপালের বিশাল সাম্রাজ্য অটুট থাকার সুযােগ পায় এবং সম্ভবত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই রাজ্য তিনি বিনা উপদ্রবে ভােগ করার সুযােগ পান ।
( ২ ) দেবপালের রাজ্যবিস্তার : ধর্মপালের পুত্র দেবপাল ৮১২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন ( ৮১২ – ৮৫০ ) । ধর্মপাল উত্তর ভারতে যে সার্বভৌমত্বের পদ লাভ করেও রক্ষা করতে পারেন নি, দেবপালের পক্ষেও সেই পদ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না । কিন্তু তিনি স্বীয় প্রতিভা ও গৌড়জনের বাহুবলের দ্বারা উত্তর ও দক্ষিণাপথের নৃপতি সমাজে শ্রেষ্ঠত্বলাভ করতে সমর্থ হন । দেবপালের আদেশে তাঁর কনিষ্ঠভ্রাতা জয়পাল উৎকল ও কামরূপে গৌড়েশ্বরের আধিপত্য বিস্তার করেন । দেবপালের পক্ষে প্রাগজ্যোতিষ ও উৎকল অধিকার করা খুব সহজ হলেও আর্যাবর্তের ওপর পুনরায় আধিপত্য বিস্তার করা খুব সহজ ছিল না ।ফলে পিতার বিলুপ্ত সাম্রাজ্য উদ্ধার সাধনে প্রয়াসী হয়ে তিনি ভারতের প্রধান প্রধান শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন । ধর্মপাল ও দেবপালের প্রধানমন্ত্রী দৰ্ভপানির প্রপৌত্র গুরুব মিশ্রের প্রতিষ্ঠিত বাদলের হরগৌরীর স্তম্ভে উত্তীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে বিন্ধ্যপর্বত থেকে হিমালয় পর্বত পর্যন্ত এবং পূর্ব সাগর থেকে পশ্চিমসাগর পর্যন্ত দেবপালের রাজ্য বিস্তৃত ছিল । সকল উত্তরপথ দেবপাল অধিকার করতে পেরেছিলেন কিনা তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও তিনি সিংহাসনে আরােহণের পরই উত্তরাপথের নরপতিগণের সঙ্গে যে যুদ্ধে ব্যাপৃত হন এবং সেই যুদ্ধে তাঁর যে কোন ক্ষতি হয় নি তা সহজ ভাবেই অনুমান করা যায় । তিনি রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ ও অমােঘবর্ষ এবং গুর্জর প্রতীহাররাজ মিহিরভােজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন এবং নিজের প্রাধান্য বজায় রাখতে সমর্থ হন । তাছাড়া চান্দেল্লরাজ শ্রীহর্ষ ও কলচুরিরাজ কোকল্পের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন । সম্ভবত এইসব শক্তি একযােগে দেবপালের বিরােধিতা না করলে তাঁর পক্ষে উত্তরাপথের সার্বভৌম রাজপদ লাভ করা সম্ভব হত ।
দেবপাল যে কলচুরি বা চেদীরাজ্য অতিক্রম করে মধ্যভারতের পশ্চিমাংশ আক্রমণ করতে সমর্থ হয়ে ছিলেন — ‘হূন - গর্ব - হরণ ’ অভিধাই তার প্রমাণ । ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যশােবর্মন কর্তৃক পরাজিত হূণরাজ মিহিরকুলের মৃত্যুর পর হূনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লেও উত্তরভারতের স্থানে স্থানে বিশেষত মধ্যভারতে দীর্ঘকাল পর্যন্ত হূন প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল । দেবপাল সম্ভবত মালবের হূণদের গর্ব ক্ষুন্ন করেন ।
গৌড়েশ্বর দেবপালের গুর্জর প্রতীহার , রাষ্ট্রকূট , চান্দেল্ল ও কলচুরিদের সঙ্গে বিরােধ গৌড়জনের সকলােত্তরাপথের একাধিপত্য লাভের তৃতীয়ত চেষ্টা । শশাঙ্ক ও ধর্মপাল এক্ষেত্রে যতদূর সফল হয়েছিলেন ঘটনাচক্রে দেবপাল ততটা সফল হতে না পারলেও পরাক্রমে তিনি শশাঙ্ক ও ধর্মপালের তুল্য আসন এবং সমসাময়িক নরগণের মধ্যে সর্বোচ্চ আসন লাভ করার যােগ্য । ধর্মপাল যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , দেবপাল তার সীমান্তস্থিত কামরূপ , উৎকল , হূনদেশ প্রভৃতি জয় করেন এবং চিরশত্রু প্রতীহারদের দমন করেন । ফলে পালরাজবংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ভারতের এক বিরাট অংশে বিস্তৃত হয়ে পড়ে ।