উত্তর : মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষদিকে সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খলার সুযােগে দাক্ষিণাত্যের আমীররা দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে হাসান শাহ নামে এক ব্যক্তির অধীনে একটি নতুন রাজ্য স্থাপন করে । নতুন রাজ্যের সুলতান হয়ে হাসান আলাউদ্দিন বাহমন শাহ উপাধি গ্রহণ করেন । এই নাম থেকেই নতুন রাজ্যের নাম হয় বাহমনী রাজ্য । এই রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল নর্মদা ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে । হাসান নিজেকে পারস্যের প্রসিদ্ধ বীর বাহমনের বংশধর বলে দাবী করতেন বলে বাহম শাহ নাম নিয়েছিলেন । ফেরিস্তার মতে প্রথম জীবনে হাসান গঙ্গু নামে এক ব্রাহ্মণের অধীনে কাজ করতেন । ব্রাহ্মণের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতঃ তিনি বাহমন শাহ নাম নেন ।
বাহমন সাম্রাজ্যের বিস্তার : আলাউদ্দিন বাহমন শাহ ১৩৪৭ থেকে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ -বিন - তুঘলকের মৃত্যু হলে বাহন শাহ দাক্ষিণাত্যের এক বিশাল অঞ্চলে বিস্তার করেন । বিদর , গােয়া দাভােল , কোলাপুর প্রভৃতি অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তৃত হয় । তার রাজধানী ছিল গুলবর্গা । সমগ্র রাজ্যকে তিনি দৌলতাবাদ , গুলবর্গা , বেয়ার ও বিদর – এই চারটি প্রদেশে বিভক্ত করেন । উত্তরে বেরার থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণ নদী এবং পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পূর্বে তেলেঙ্গানা পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ।
ফিরােজ শাহের গুণাবলী : মহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনের অধিকার নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সংগ্রামের ফলে কুড়ি বছরে বাহমনী রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল । অবশেষে ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে ফিরােজ শাহ সুলতান হলে রাজ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় । এই সময়ে বাহমনী রাজ্যের সঙ্গে বিজয়নগর রাজ্যের তিনবার যুদ্ধ হয় । প্রথম দুবার ফিরােজশাহ জয়লাভ করলেও তৃতীয়বার বিজয়নগরের কাছে তিনি পরাজিত হন । ফিরােজ শাহের সময় বামনী রাজ্য ভারতবর্ষের সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে ।
আহমেদ শাহের কৃতিত্ব : ১৪২২ খ্রিস্টাব্দে ফিরােজ শাহকে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত করে আহম্মদ শাহ সুলাতন হন । আহম্মদ শাহ ছিলেন রণনিপুন যােদ্ধা । বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায়কে পরাজিত করে তিনি প্রচুরক্ষ তিপূরণ ও বার্ষিক কর দানের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন । এছাড়া বরঙ্গলের কাকতীয় রাজাকে পরাজিত করে বরঙ্গলকে তিনি নিজ রাজ্যভুক্ত করেন । খান্দেশের সুলতানকেও তিনি পরাজিত করেন । কিন্তু উড়িষ্যার বিরুদ্ধে তার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল । তিনি বাহমনী রাজ্যের রাজধানী গুলবর্গা থেকে বিদরে স্থানান্তরিত করেন । ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয় ।
মামুদ গাওয়ানের উত্থান ও কৃতিত্ব : পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দিন ( ১৪৩৫ - ৫৭ ) বিজয়নগরকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন । তার পর সিংহাসনে বসেন হুমায়ন শাহ ( ১৪৫৭-৬১ ) । তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন বলে ‘জালিম’ নামে অভিহিত হতেন । হুমায়ন শাহের মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র সিংহাসন লাভ করেন । নাবালক সুলতানের মন্ত্রীরূপে প্রকৃত ক্ষমতা ভােগ করতেন মামুদ গাওয়ান । সাহসী , প্রজা হিতৈষী , ন্যায়পরায়ণ , বিদ্যোৎসাহী মামুদ গাওয়ানের সময় বাহমনী রাজ্য উন্নতির শিখরে আরােহণ করেছিল ।
বাহনীর পতন : পরবর্তীকালে ঈর্ষান্বিত ওমরাহরা মামুদ গাওয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে রাজদ্রোহের অভিযােগে অভিযুক্ত করেন । ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান তৃতীয় মহম্মদ শাহ মামুদ গাওয়ানকে মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত করেন । মামুদের মৃত্যুর পর শাসকদের দুর্বলতার সুযােগে বাহমানী রাজ্যের দ্রুত পতন হয় । প্রাদেশিক শাসনকর্তারা একে একে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে বামনী রাজ্য ভেঙে পাঁচটি রাজ্যের উদ্ভব হয় । এই পাঁচটি রাজ্য হল বিজাপুর ,গােলকুণ্ডা , আহম্মদনগর , বেরার ও বিদর ।
বাহমনীর পাঁচটি রাজ্যের জন্ম : বাহমনী রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর যে পাঁচটি সুলতানী রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল , তার মধ্যে বিজাপুরের রাজ্যটি ছিল সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য । ইউসুফ
আদিল শাহ ছিলেন বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ।তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ আদিল শাহী বংশ নামে পরিচিত । মামুদ গাওয়ানের অধীনে আদিল শাহ উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন । ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বাধীন বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি ছিলেন সুদক্ষ শাসক ও ধর্ম সম্পর্কে উদার । তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারক ও প্রজাহিতৈষী শাসক । বিদ্যা ও বিদ্বানদের প্রতি তার অনুরাগ ছিল প্রবল । এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহ ( ১৫৭৯ -১৬২৬ খ্রিঃ ) । ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব বিজাপুর রাজ্যটি মােঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন ।
মােঘল সাম্রাজ্যভুক্ত গােলকুণ্ডা : অপরদিকে রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুতুব শাহ । তিনি প্রথমে ছিলেন বামনী রাজ্যের একজন তুর্কী কর্মচারী । ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন । ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব এই রাজ্যটি মােঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন ।
মােঘল সাম্রাজ্যভুক্ত আহম্মদনগর : আহম্মদনগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মালিক আহম্মদ । ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন । তিনি আহম্মদনগরের প্রতিষ্ঠা করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন । ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ওই রাজ্যের পতন শুরু হয় ।
তালিকোটার যুদ্ধ : উপরােক্ত পাঁচটি সুলতানি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা রাজ্যের কয়েকজন দক্ষ শাসকের আবির্ভাব হয়েছিল । হিন্দু সাম্রাজ্য বিজয়নগরের সঙ্গে এই পাঁচটি সুলতানি রাজ্যের দীর্ঘকাল যুদ্ধবিগ্রহ চলেছিল । অবশেষে তারা সম্মিলিতভাবে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগরকে পরাজিত করেন । কিন্তু এদের পারস্পরিক বাদ -বিসম্বাদ দক্ষিণ ভারতের শান্তি ও শৃঙ্খলার পথে অন্তরায় হয়ে উঠেছিল এবং পরবর্তীকালে একে একে রাজ্যগুলি মােঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ।