ভারতে সামন্ত প্রথার উৎপত্তি সম্বন্ধে কি জান ? এর ফলাফল কি হয় ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর ভারতে সামন্ত প্রথার উৎপত্তি সম্বন্ধে কি জান এর ফলাফল কি হয় bharoter samonto prothar utpotti sombondhe ki jano ar folafol ki hoi questions answers


উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা ; সাধারণভাবে মনে করা হয় যে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই উত্তর - দক্ষিণ ভারতের যে রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা দেয় তার ফলে ভারতে সামন্ত প্রথার উদ্ভব ঘটে । শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অনুপস্থিতি এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির উদ্ভব নিঃসন্দেহে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ । আবার এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন দেখা দেয় । এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রােমিলা থাপার মন্তব্য করেন , কেন্দ্রীয় শাসনের পরিবর্তে এই যে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে তাকেই ব্যাপক অর্থে সামন্ততন্ত্র বলা যায় । প্রথমে উত্তর ভারতের এবং পরে দক্ষিণ ভারতে এই সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠেছিল । ইয়ােরােপের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ভারতের সামন্ততন্ত্রের কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয় পদ্ধতির মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। 



( ২ ) সামন্তপ্রথার বৈশিষ্ট্য : সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তগুলাে প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে ছিল । সামন্ত প্রথার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ( ক ) ভূমির স্বত্বের বৈশিষ্ট্য এবং ( খ ) ভূম্যধিকারীদের রাজ্য শাসনের ক্ষমতা । মৌর্যোত্তর যুগের কয়েকটি ভূমিদাস সংক্রান্ত লিপি পাওয়া গিয়েছে যাতে জমি দান করার সঙ্গে সঙ্গে তার শাসনের অধিকারও দেওয়া হয়েছে । ফলে ভূমির প্রাপক জমিদারীর সঙ্গে সঙ্গে শাসক ক্ষমতাও লাভ করে । এইভাবে সামন্ত প্রভুর শাসনের ক্ষমতা গড়ে ওঠে । খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় অব্দে সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধ শ্ৰমনদের শাসনের অধিকার সহ ভূমি দান করেন । এই দানপত্রে আরও বলা হয় যে, এই জমিতে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী , পুলিস বা অন্যান্য কর্মচারী প্রবেশ করতে পারবে না ।এই ব্যবস্থা থেকে বুঝা যায় যে সামন্ত তার অধীনস্থ অঞ্চলের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা সামগ্রিক ভাবে ভােগ করার সুযােগ পেত । বকাটক রাজ দ্বিতীয় প্রবর সেনও অনুরুপ শর্তে জমি দান করেন । এইসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্তপ্রথা গড়ে ওঠার সুযােগ পায় ।



 ( ৩ ) সামন্ত প্রথার উদ্ভবের কারণ : গুপ্তযুগের ব্ৰত্মত্র বা ব্ৰত্মদেয় ভূমিদান লিপি সমূহে সামন্ত প্রথার লক্ষণ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় । এই সব অঞ্চলের অধিবাসীদের আনুগত্য ছাড়াও কর , শুল্ক প্রভৃতি রাজার পরিবর্তে ভূমি গ্রহীতা ব্রাত্মণকে দিতে বলা হয় । তাছাড়া রাজকীয় সৈন্য এবং কর্মচারীদেরও এই ভূমির ওপর কর্তৃত্ব করার কোন সুযােগ ছিল না । বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতাও রাজার কাছ থেকে ব্রাত্মণের কাছে হস্তান্তরিত হয় । এর ফলে কর আদায় ও আইন - শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্ত ক্ষমতাই ভূমি গ্রহীতা ভােগ করার সুযােগ পায় । বুদ্ধঘােষের পালিগ্রন্থে ব্ৰত্মদেয় জমি বলতে জমিগ্রহীতার জমির ওপর সমস্ত অধিকার অর্থাৎ শাসন , কর আদায় ও বিচারকার্য পরিচালনা করার অধিকার বুঝায় । এই সব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেই সামন্তপ্রথা প্রতিষ্ঠিত হয় । 
 

সামন্ত প্রথার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রধান সামন্ত কর্তৃক আনুগত্যের ভিত্তিতে অধীনস্থ সামন্তদের মধ্যে ভূমি বন্দোবস্ত করা । ৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রচারিত স্বামিদাস লিপিতে উল্লেখ আছে যে তিনি এক বণিককে তার জমি দান করার অনুমতি দেন । অনেক সময় রাজকর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল । ফলে কর আদায়ের ব্যাপারটা অনেকাংশে জায়গীরদার ও স্থানীয় জমিদারদের হাতে চলে যায় । কিন্তু রাজা সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে কর আদায় করতেন । চীনা পরিব্রাজক ফা- হিয়েনের বিবরণ থেকে জানা যায় যে সাধারণ লােকেদের ঘরবাড়ী সরকারী দলিল দস্তাবেজ প্রভৃতি নথিভুক্ত করা হত না । এই বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে ভূমির ওপর রাজার অধিকার অনেক ক্ষেত্রে লােপ পেয়ে ছিল । 



গুপ্তরাজবংশের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয় । এই সময় বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু রাজ্যের উৎপত্তি ঘটে এবং গুপ্তদের শাসনকালের শেষদিকে যে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের শুরু হয়েছিল পরে তা আরও বৃদ্ধি পায় । এই সময় বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দানের প্রথাও খুব বেড়ে যায় । এই সব জমির প্রাপকদের বলা হত ভােগপটিকা বা ভােগীকা যার অর্থ হল ভােগকারী । খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মহাভােগী নামে একটি শ্রেণীর উদ্ভব হয় । বড় বড় সামন্তগণই সম্ভবত মহাভােগী নামে পরিচিত ছিল । অনেক সময় এরা বংশানুক্রমিক ভাবে জমি ভােগ করত । 



( ৪ ) সামন্তদের শ্রেণী বিভাগ : রাজার সঙ্গে সামন্তদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও সামন্তরা ছিল রাজার অধীন । সম্পর্কের খুঁটিনাটি নির্ভর করত কিভাবে এই সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অনেকাংশে তার ওপর । আবার এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামন্তদের শ্রেণীবিভাগ নির্ণয় করা হত । ব্ৰত্মত্র বা ব্ৰত্মদেয় গােষ্ঠীর সামন্তগণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণীর । তাদের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক ছিল পৃথক ধরনের । রাজার প্রতি কর্তব্য পালনের ব্যাপারেও অন্যান্য সামন্তদের সঙ্গে এদের পার্থক্য ছিল । রাজস্ব আদায় , শাসনব্যবস্থা প্রভৃতির ব্যাপারেও তারা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভােগ করত । ক্ষমতাশীল সামন্তরা নিজেদের ইচ্ছামতাে ভূমিদান করতে পারত । এই ধরনের সামন্তদের অধীনে আবার কিছু উপসামন্ত থাকত । এই ভাবে ক্রমনিম্ন বিভাগের সৃষ্টি হত । গুপ্তযুগের শেষ দিকের একটি শিলালিপিতে এই ধরনের ব্যবস্থার উল্লেখ দেখা যায় । ইয়ােরােপের সামন্তপ্রথার সঙ্গে ভারতের সামন্তপ্রথার অনেক সাদৃশ্যও এখানে খুঁজে পাওয়া যায় । সামন্তপ্রথার সর্বোচ্চ ছিলেন রাজা এবং সর্বনিম্ন প্রান্তে ছিল সবচেয়ে ছােটসামন্ত এবং তার অধীনস্থ কৃষকগণ । ইয়ােরােপের সামন্ত ব্যবস্থার মতাে ভারতের রাজাদের সঙ্গেও কৃষকদের কোন সম্পর্ক ছিল না বিভিন্ন শ্রেণীর সামন্তদের মাধ্যমে উভয়পক্ষের মধ্যে পরােক্ষ যােগসূত্র গড়ে ওঠত । পদমর্যাদা অনুযায়ী সামন্তদের উপাধি হত ‘ মহাসামন্ত ’ ‘মহামন্ডলেশ্বর’ প্রভৃতি আর ছােট সামন্তদের উপাধি হত ‘রাজা’ ‘সামন্ত’ ‘ ঠাকুর‘ ‘রাণক’ ‘ভাক্তা’ প্রভৃতি । অনেক সময় সামন্তদের ‘মহারাজ’ উপাধি গ্রহণ করতেও দেখা যায় । পল্লব রাজগণও ‘সামন্ত সুধামণি’ অভিধা সৎ ও উচ্চবংশীয় সামন্তদের সম্পর্কে ব্যবহার করতেন । 




( ৫ ) সামন্তদের দায়িত্ব ও কর্তব্য : নিয়মিত খাজনা দেওয়া ও রাজার প্রয়ােজনের জন্য কিছু সংখ্যক সৈনিকের ভরণপােষণ করা ছাড়াও সামন্তদের আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হত । রাজার জন্মদিন উপলক্ষে রাজসভায় হাজির থাকা সামন্তদের অবশ্য কর্তব্য ছিল । তাছাড়া সাধারণত সামন্তদের যে সব দায়িত্ব পালন করতে হত সেগুলাে হল ( ক ) প্রভুর মাথায় ছাতা ধরা ; (খ ) প্রভুর সিংহদ্বারে প্রতিহার বা প্রহরীর কাজ করা ; ( গ) প্রভুর সম্মুখে মন্ত্রপাঠ করে তার মঙ্গল কামনা করা ; ( ঘ ) প্রভুর সঙ্গে নিজকন্যা বা ভগ্নীর বিবাহ দান ;( ঙ ) প্রভুর কাছে নিজপুত্রকে জামিন রাখা প্রভৃতি । আবার অনেক সময় প্রভুকে সঙ্গদান ,মৃগয়া প্রভৃতিতে অংশ গ্রহণ করা নিয়মিত দরবারে উপস্থিত থেকে আনুগত্যের মনােভাব প্রকাশ করা ও সামন্তদের কর্তব্য বলে বিবেচিত হত । এই সব প্রথা মেনে চলার পরিবর্তেই সামন্তগণ নানারুপ উপাধি গ্রহণ করতে পারত এবং রাজার অনুমতি অনুসারে হাতি , ঘােড়া ছাড়াও অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করতে পারত । 


( ৫ ) ফলাফল : শাসনব্যবস্থার প্রয়ােজনের দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে , সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কোন আমলাতন্ত্রের প্রয়ােজন ছিল না । সামন্তরা কর আদায় করত এবং বিচারের দায়িত্বও নিতে পারত । কারণ বিবাদ বিসংবাদের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার মতাে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল । এইরুপ অবস্থায় শাসন দায়িত্বের অনেকাংশই তারা পরিচালনা করত । অন্যদিকে ব্রাত্মণগণকে নতুন নতুন এলাকায় ভূমিদান করা হত এবং সেখানে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিস্তার করার দায়িত্ব গ্রহণ করত । এই ভাবে সামন্তপ্রথা একদিকে সামরিক শক্তির এবং অপরদিকে সংস্কৃতির বিস্তারের পথ সুগম করে তােলে । 



কিন্তু শক্তিশালী এই সব সামন্তদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের । কেন্দ্রীয় সরকারের কোন প্রকার দুর্বলতা দেখা দিলেই সামরিক শক্তিতে বলীয়ান সামন্তগণ স্বাধীনভাবে রাজ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করত । কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযােগেই মান্দাসসারের যশােধর্মন , গৌড় বঙ্গের শশাঙ্ক ছাড়াও গুজরপ্রতিহার প্রভৃতি রাজপুত পরিবারগুলাে নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন । এই ভাবে দেশের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয় এবং আঞ্চলিকতা বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় । 


সামন্তপ্রথার আর একটি কুফল ছিল মধ্যস্বত্বভােগী উপসামন্তদের উদ্ভব । বিভিন্ন বর্ণের মধ্যস্বত্ব ভােগীদের চাপে জমির করের হার বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে । সে যুগে ভারতের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিনির্ভর এবং কৃষির উদ্বৃত্ত অর্থে সামরিক শক্তি বজায় রাখার চেষ্টার ফলে কৃষকগণ সব দিক থেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত । সামন্তগণ এক দিকে যেমন জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করতে পারত তেমনই তারা কৃষকদের কাছ থেকে বেগারশ্রম আদায় করে নিতে পারত । প্রয়ােজন অনুসারে জমির করের হারের বৃদ্ধি করেও তারা কৃষকদের জীবন অসহ্য করে তুলত । আবার সামন্তগণ কৃষি নির্ভর অর্থনীতির পরিপূরক হিসাবে কোন শিল্প গড়ে তােলার কোন চেষ্টা করে নি । ফলে একটি কর্মবিমুখ অলস সমাজের সৃষ্টি হয় । সামন্তগণ ধীরে ধীরে বিলাস ব্যসনে লিপ্ত হতে থাকে এবং তাদের পূর্বেকার সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক দক্ষতা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয় । সমাজের এই অবক্ষয়ের যুগে মুসলিম আক্রমণকারীরা অতি সহজেই এদেশ পদানত করতে সমর্থ হয় ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন