গুপ্তযুগকে প্রাচীন ভারতের সুবর্ণযুগ বলা কতদূর সমর্থনযােগ্য ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর গুপ্তযুগকে প্রাচীন ভারতের সুবর্ণযুগ বলা কতদূর সমর্থনযােগ্য guptojugke prachin bharoter subornojug bola kotodur somorthonjogyo questions answers

উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা : গুপ্তযুগে ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত  হয় এবং সেজন্য এযুগকে যুক্তিসঙ্গত ভাবেই প্রাচীন ভারতের সুবর্ণযুগ বলা হয় । জ্ঞান বিজ্ঞান , শিল্প সাহিত্য , সভ্যতা , সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তুলনাহীন উন্নতির জন্য ঐতিহাসিকগণ গুপ্তযুগকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যান্য গৌরবময় যুগের সঙ্গে তুলনা করেন । ঐতিহাসিক বার্ণো গুপ্তযুগকে গ্রীসের পেরিক্লিসের যুগের সঙ্গে তুলনা করেন । ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ গুপ্তযুগকে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ এবং স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলের সঙ্গে তুলনা করেন । এইরুপ তুলনা অতিরঞ্জিত বা উচ্ছ্বাসপূর্ণ নয়, এবং প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । গুপ্তযুগ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ধ্রুপদী রীতির ক্রমবিকাশের যুগ নামে পরিচিত এবং এই যুগে ভারতীয় সভ্যতা চরম উন্নতি লাভ করে । ডক্টর কে .এম .মুন্সীর মতে গুপ্তসম্রাটগণ অসাধারণ জাতীয় শক্তির উন্মেষের প্রতীক রূপে চিহ্নিত হন । তাঁর মতে এই সুবর্ণ ভারতীয়দের জীবন যে পরিমাণ সুখপূর্ণ এবং ভারতীয়দের সংস্কৃতি যে পরিমাণ সৃজনধর্মী হয়ে ওঠেছিল তা কোন যুগে হয় নি । 



কিন্তু আধুনিক কালের অনেক ঐতিহাসিক গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলে আখ্যা দিতে আপত্তি করেন । বিশেষত ব্রাত্মণ্য ধর্মের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা গুপ্তযুগের নবজাগরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রাত্মণ্য সমাজ ব্যবস্থা , বর্ণভেদ প্রথা এবং উচ্চশ্রেণীর লােকেরাই এই সময় সামাজিক সুবিধা ভােগ করত । এই যুগেও সাধারণ লােকের অবস্থার কোন পরিবর্তন সাহিত্য ও শিল্পচর্চাও উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । তাছাড়া সংস্কৃতির উন্নতি উত্তর ভারতের সীমানা অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করে নি । সংক্ষেপে বলা যায় যে এক সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যেই এই সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও উন্নতি ঘটে । তা সত্ত্বেও মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতার জন্য গুপ্তযুগের সাহিত্য , দর্শন চিরকাল ভারতীয়দের নিকটের গৌরবের বস্তু বলে বিবেচিত হবে । 

( ২ ) সভ্যতা বিকাশের কারণ : দীর্ঘদিন রাজনীতিগত ভাবে বিছিন্ন থাকার পর গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত , দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রভৃতির প্রচেষ্টায় ভারতে  পুনরায় রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় । তবে কেবল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির মধ্যে নয়, সাম্রাজ্যের শাসন পদ্ধতির মধ্যেও গুপ্তযুগের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় । চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এর বিবরণ থেকে গুপ্তশাসন ব্যবস্থার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে গুপ্তদের অধীনে সমগ্র দেশ সুশাসিত এবং সুসংগঠিত ছিল । গুপ্তশাসকদের নৈপুণ্য ও প্রজাহিতৈষণা সমগ্র দেশে শান্তি এবং সমৃদ্ধি। এনেছিল । যােগাযোেগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকায় ব্যবসা  বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে এবং মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই উন্নতির প্রভাব দেখা যায় । জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতাে ধর্মীয় জীবনেও যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা দেয় । বৈদিক আমলের দেব - দেব - দেবী প্রভৃতির পৌরাণিক দেব দেবী , বিষ্ণু, শিব , দুর্গা প্রভৃতির পূজা প্রচলিত হয় । অপর দিকে বৈদিক যাগযজ্ঞের পরিবর্তে ভক্তিমূলক ধর্মের প্রাধান্য বিস্তৃত হয় । এর ফলে সমাজ জীবন পরিবর্তিত হওয়ার পথ সুগম হয় । 


 


( ৩ ) গুপ্তযুগের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য : জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলার গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ বলে অভিহিত করেন । কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এই মতকে গ্রহণযােগ্য বলে মনে করেন না । কারণ গুপ্তদের  পূর্ববর্তীকালে অর্থাৎ মৌর্য ও কুষাণ মনে করেন , গুপ্তযুগের সংস্কৃতির উৎকর্ষের মূলে ছিল বৈদেশিক প্রভাব । কিন্তু বৈদেশিক সংযােগের ফলেই যে গুপ্তযুগে সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল তা বলা যায় না । গুপ্ত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও এর অন্তর্নিহিত প্রেরণা ছিল ভারতীয় । প্রকৃতপক্ষে গুপ্তযুগের সংস্কৃতি ছিল ভারতীয় । প্রকৃতপক্ষে গুপ্তযুগের সংস্কৃতি ছিল ভারতীয় সভ্যতার গতিধারার চরম বিকাশ । 


( ৪ ) সাহিত্য : গুপ্তযুগ অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভাষার উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত । গুপ্তসম্রাটদের পৃষ্ঠপােষকতায় এবং দেশের অনুকূল পরিবেশে সংস্কৃতভাষা ও সাহিত্যের খুব উন্নতি ঘটে । এই যুগের শিলালিপি ও সাহিত্য সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছিল । তবে সংস্কৃত ভাষা মূলত রাজ দরবার ও অভিজাত বর্গের ভাষায় পরিণত হলেও সাধারণ লােক প্রকৃত ভাষাই ব্যবহার করত । কালিদাসের নাটকে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায় । আবার সংস্কৃত ভাষা ব্রাত্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির বাহনে পরিণত হলেও জৈনগণ প্রাকৃতের মাধ্যমেই ধর্ম সাহিত্য রচনা এবং ধর্মপ্রচার করতেন । 


ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে গুপ্তযুগে কাত্যায়ণ স্মৃতি, দেবলস্মৃতি , নারদ স্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি প্রভৃতি সঙ্কলিত হয় । অষ্টাদশ পুরাণের কয়েকখানি পুরাণ এই যুগে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয় । সম্ভবত রামায়ণ ও মহাভারত এই কাব্যদ্বয়ও এই যুগে অনেকাংশে নতুন করে সঙ্কলিত হয় । 


দর্শন শাস্ত্রের মধ্যে ঈশ্বরকৃষ্ণ ‘সাংখ্যকারিক’ এবং বসুবন্ধু ‘পরমার্থ সপ্ততি’ ব্যাখ্যা করেন । বসুন্ধুর ভ্রাতা অসঙ্গ যােগাচার শাস্ত্রের ওপর যােগাচার ভূমিশাস্ত্র নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন । ন্যায়শাস্ত্র জনক পলিম্বামিন এবং দার্শনিক দিন্নাগাচার্য এই যুগকে অলঙ্কৃত করেন । শঙ্করাচার্যের গুরু বেদান্ত দর্শনের প্রবক্তা গৌড়পাদও এইযুগে জন্ম গ্রহণ করেন । 



ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগের দান অপরিসীম । গুপ্তযুগের সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কালিদাস সংস্কৃত সাহিত্যকে নতুন জীবনদান করে । কালিদাসের আবিভাবের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরােধ থাকলেও সাধারণত তাকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক বলে মনে করা হয় । তাঁর রচিত নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌ বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে স্বীকৃত হয় । তাঁর রচিত নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম বিক্রমােৰ্বশী এবং কাব্য রঘুবংশম , কুমার সম্ভবম , গীতিকাব্য মেঘদূতম প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্যরত্ন রুপে বিবেচিত হয় । কালিদাস ব্যতীত কিরাতার্জনীয়ম - এর রচয়িতা ভারবি । মৃচ্ছকটিকম এর রচয়িতা শূদ্রক এবং মুদ্রারাক্ষসম এর রচয়িতা বিশাখ দত্তের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । এলাহাবাদ প্রশস্তির কবি হরিষেন সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন । বৈয়াকরণ ও কবি বীরসেন চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন । কিংবদন্তী অনুসারে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভা নবরত্ন অর্থাৎ ন'জন কবি, দার্শনিক, সাহিত্যিক প্রভৃতি মনিষীর দ্বারা সুশােভিত ছিল । কাব্য ছাড়াও সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যেরও এই সময় প্রচুর উন্নতি সাধিত হয় । এই প্রসঙ্গে বিষ্ণু শর্মার পঞ্চতন্ত্র এবং গুনাট্যের বৃহৎকথার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য ।  কাব্য দর্শন ও দশকুমার চরিতের লেখক দন্ডিন গদ্য রচনায় অপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দেন । বাৎসায়ন রচিত কামসূত্র এবং কামন্দকের নীতিসার প্রভৃতি এই যুগের উল্লেখযােগ্য রচনা ।


( 8 ) জ্ঞান বিজ্ঞান : বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে আশ্চর্যজনক উন্নতি লক্ষ্য করা যায় ।  আর্যভট্ট , বরাহমিহির ব্রহ্মগুপ্ত প্রভৃতি খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক এই যুগে জন্মগ্রহণ করেন । এই যুগে গণিতশাস্ত্র রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান , চিকিৎসাবিজ্ঞান , জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি হয় । ব্যাবহারিক ও ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা পঞ্চসিদ্ধান্তের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য । পঞসিদ্ধান্ত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে পরিগণিত হয় । জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও বরাহমিহির জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কেও বিশদভাবে আলােচনা করেন । তবে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাবিদ আর্যভট্টের মধ্যে এই যুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপূর্ণ বিকাশ দেখা যায় । তিনিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতি নির্ণয় করেন সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করেন । ভারতের বীজগণিত ও জ্যামিতির প্রচলন এই যুগেই শুরু হয় আর্যভট্ট ও বরাহ মিহিরের চিন্তাধারার ওপর গ্রীকদের প্রভাবের কথা অনেকে উল্লেখ করেন , কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মৌলিকত্ব অস্বীকার করা যায় না । 



অভিধানপ্রনেতা অমর সিংহ ও চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থের রচয়িতা ভাগবত এই যুগেই জন্মগ্রহণ করেন । শল্য চিকিৎসাও এই যুগে প্রভূত উন্নতি করে এবং সদ্য চিকিৎসকরুপে সুশ্রুত খুব প্রসিদ্ধিলাভ করেন । 




( ৫ ) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় । এই যুগের শিল্পকলার বহু নিদর্শন বৈদেশিক আক্রমণকারীদের দ্বারা বিধ্বস্ত হয়ে যায় । সেজন্য গুপ্তযুগের স্থাপত্য শিল্পের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না । তবে উত্তরপ্রদেশের অন্তর্গত দেওগড়ের একটি প্রস্তর নির্মিত মন্দির কানপুরের নিকটে অবস্থিত ভিতরগাঁও এর একটি ইস্টক নির্মিত মন্দির এবং সারনাল আবিষ্কৃত একটি প্রস্তর নির্মিত মন্দির গুপ্তযুগের স্থাপত্য শিল্পের অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করে । 



ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগে অভাবনীয় উন্নতি দেখা দেয় । পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে এবং বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের আদর্শ অনুসরণ করে গুপ্তযুগের ভাস্কর্য শিল্পীগণ তাদের শিল্পকুশলতার পরিচয় দেয় । সারনাথ ও মথুরার প্রাপ্ত দেব দেবীর মূর্তিগুলাের সূক্ষভাস্কর্য খুবই প্রশংসনীয় । 



( ৬ ) চিত্রশিল্প : অজন্তার গুহাচিত্রগুলাে থেকে গুপ্তযুগের চিত্র শিল্পের উন্নতির প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় । পর্বতগাত্র কেটে গুহামন্দির নির্মাণ ও মন্দিরের দেওয়াল গাত্রের চিত্র অঙ্কন গুপ্তযুগের চিত্র শিল্পের চরম উৎকর্ষের পরিচায়ক । এই সব চিত্র শিল্পের বিষয় বস্তুরও বৈচিত্র্য দেখা যায় । বুদ্ধদেবের জীবনের বহু ঘটনা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর নর - নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবিও এইসব চিত্রে অঙ্কিত হয়েছে । মালবের গুহা চিত্রগুলাে খুবই উন্নত শ্রেণীর ।


( ৭ ) ধাতুশিল্প : গুপ্তযুগে ধাতুশিল্প ও অসামান্য উন্নতি লাভ করে । দিল্লীর নিকটে অবস্থিত  চন্দ্ররাজের লৌহস্তম্ভ এখনও দর্শকদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে । নালন্দার প্রাপ্ত বুদ্ধদেবের একটি তাম্রমূর্তি এবং অসংখ্য মুদ্রা এই যুগের ধাতু শিল্পের উন্নতির প্রমাণ দেয় । 






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন