চালুক্যবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন ? বিজেতা ও শাসক হিসাবে তার । কৃতিত্বের বিবরণ দাও ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর চালুক্যবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কে ছিলেন বিজেতা ও শাসক হিসাবে তার কৃতিত্বের বিবরণ দাও chalukkobongsher sreshta raja ke chilen bijeta o shasok hisabe tar krititter biborno dao questions answers


উত্তর : ( ১ ) বাতাপির চালুক্য রাজবংশ : দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে চালুক্য রাজবংশের কৃতিত্ব নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য । ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় দুশ বছর দাক্ষিণাত্যে এবং দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে চালুক্যরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানঅধিকার করেছিলেন । ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রণরাগের  ‘প্রিয়পুত্র’ প্রথম পুলকেশী বর্তমান বিজাপুর জেলায় একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । বাতাপি অথবা বাদাসিতে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন । তাঁর উত্তরাধিকারী ও পুত্র প্রথম কীর্তিবর্মনের সময় রাজ্যের সীমা কোঙ্কন ও কানাড়া অঞ্চলে বিস্তারলাভ করে । প্রথম কীর্তিবর্মনের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা মঙ্গলেশ সিংহাসনে আরােহণ করেন । কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম কীর্তিবর্মনের পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী এক গৃহযুদ্ধে মঙ্গলেশকে পরাজিত ও নিহত করে পিতৃসিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন । 




( ২ ) দ্বিতীয় পুলকেশী : বাদামির চালুক্য রাজবংশের মহারাজা দ্বিতীয় পুলকেশী ৬১০ - ৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । দ্বিতীয় পুলকেশী তাঁর বিরুদ ‘সত্যাশ্রয়’ দ্বারাই বিশেষভাবে পরিচিত । তিনি বল্লভ , বল্লভরাজ , বল্লভেন্দ্র, পৃথিবল্লভ , শ্রীপৃথিবল্লভ প্রভৃতি নামের দ্বারাও পরিচিত এবং সিংহাসন আরােহণের পর তিনি রাজকীয় উপাধি ও দ্বিতীয় নাম হিসাবে পরমেশ্বর নামটিও ব্যবহার করতেন । পরবর্তীকালে চালুক্যরাজগণ রাজকীয় উপাধি হিসাবে মহারাজাধিরাজ , পবমভট্টারক প্রভৃতি উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং দ্বিতীয় পুলকেশীর নামের সঙ্গেও এগুলাে যুক্ত হয় । ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ নাসিক জেলায় প্রাপ্ত লােহনের শিলালিপিতে দ্বিতীয় পুলকেশীকে পরমভাগবত অর্থাৎ বিষ্ণুর উপাসক রূপে বর্ণনা করা হয় । 


দ্বিতীয় পুলকেশী সিংহাসন আরােহণের পূর্বে চালুক্য রাজ্যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক অশান্তি বিরাজ করছিল । প্রতিবেশী রাজ্যগুলােরও চালুক্য রাজ্যের বিভিন্ন অংশ অধিকার করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে ।বুদ্ধি চাতুর্য ও কূটনীতির সাহায্যে দ্বিতীয় পুলকেশী রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি স্থাপনের পর প্রতিবেশী রাজ্য সমূহের আনুগত্য লাভ এবং নতুন নতুন রাজ্যজয়ের জন্য একটি ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন । দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্যজয়ের কাহিনী জৈন কবি রবিকীর্তি রচিত আইহােল শিলালিপিতে পাওয়া যায় । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রবিকীর্তি আইহােল শিলালিপিতে নিজেকে কবি ভারবি ও কালিদাসের সমকক্ষ বলে দাবি করেন । তবে এই শিলালিপিতেই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি কালিদাসের নামােল্লেখ দেখা যায় । 


রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে দ্বিতীয় পুলকেশী ভীমরথী নদীর উত্তর - তীরে বিদ্রোহী রাজা আগ্লায়িককে পরাজিত করেন রাজা আগ্লায়িকের সহযােগী রাজা গােবিন্দও দ্বিতীয় পুলকেশীর বশ্যতা স্বীকার করেন । তিনি কদম্বদের রাজধানী বনবাস অধিকার করেন এবং দক্ষিণ কানাড়ার আলুপ ও মহীশূরের গঙ্গ রাজাদের তাঁর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করেন । উত্তর কোঙ্কন অঞ্চলের মৌর্যরাও চালুক্যদের প্রাধান্য স্বীকার করতে বাধ্য হয় । 


( ৩ ) উত্তর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক : আইহােল শিলালিপিতে উত্তর ভারতের থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের দ্বিতীয় পুলকেশীর সংঘর্যের কথাও উল্লেখ করা হয় । দ্বিতীয় পুলকেশী ও হর্ষবর্ধনের মধ্যে সংঘর্ষে কোন পক্ষ জয়লাভ করেছিল সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিরােধ থাকলেও সমসাময়িক চীনা পরিব্রাজক হিউ এন -সাঙ - এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনের আক্রমণ প্রতিরােধ করেন । সাধারণ ভাবে মনে করা হয় যে মধ্য দেশের অধিপতি হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দক্ষিণাপথের অধিপতি দ্বিতীয় পুলকেশীর মধ্যে এটই সংঘর্ষের প্রধান কারণ ছিল ভারতের অপরান্ত অঞ্চলে অবস্থিত বর্তমান গুজরাট প্রদেশের ওপর উভয় শক্তির আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা । সম্ভবত এই সময় লাট , মালব , গুর্জর, বলভি প্রভৃতি রাজ্যসমূহ হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতিতে সন্ত্রস্ত হয়ে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সাহায্য প্রার্থনা করে । কিন্তু তথ্যাদির অভাবে এই সম্পর্কে সঠিক কোন মতামত দেওয়া যায় না । ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে হিউ এন -সাঙ দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্য ভ্রমণ করেন । তিনি সেখানকার ক্ষত্রিয় রাজা । দ্বিতীয় পুলকেশী তাঁর রাজধানী এবং তাঁর শাসন প্রনালীর খুব প্রশংসা করেন । দ্বিতীয় পুলকেশী বাদামির চালুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি এবং নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন । তাঁর সুখ্যাতি ভারতের সীমানার বাইরেও বিস্তৃত হয় । মুসলিম ঐতিহাসিক তাবারির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, পারস্যের সুলতান ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে চালুক্য রাজের প্রেরিত দূতকে অভ্যর্থনা জানান । অপর দিকে অজন্তার একটি চিত্রে পারস্য রাজের প্রেরিত দূতের প্রতি দ্বিতীয় পুলকেশীর অভ্যর্থনার ঘটনা অঙ্কিত রয়েছে ।তবে পল্লবদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চালুক্যরাজ বংশের ওপর বিরাট আঘাত স্বরুপ দেখা দেয় । 


( ৪ ) চালুক্য পল্লব বিরােধের সূত্রপাত : সিংহাসনে আরােহণ করার তিন চার বছর পরে পুলকেশী কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিষ্ণুবর্ধনকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে দাক্ষিণাত্যের পূর্বাঞলে বিজয় অভিযানে বার হন । এই অভিযানের প্রারম্ভেই দক্ষিণ কোশল এবং কলিঙ্গ রাজ্য তার বশ্যতা স্বীকার করে । এর পর তিনি পিষ্ঠপুর অধিকার করেন । দক্ষিণ ভারতে নবগঠিত পল্লব রাজ্যে চালুক্যদের প্রতিদ্বন্দ্বীরুপে দেখা দেয় । দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লবরাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে পল্লব রাজধানীর অনতিদূরে উপস্থিত হন এবং পল্লব রাজ্যর উত্তর দিকের কিছু অংশ জয় করেন । প্রথম বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লব রাজ্য আক্রমণ করেন । তিনি সসৈন্যে পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চিপুরমের নিকটবর্তী অঞলে উপস্থিত হন । কিন্তু এবার তিনি রাজা মহেন্দ্রবর্মনের পুত্র নরসিংহবর্মনের হাতে শােচনীয় ভাবে পরাজিত হন । নরসিংহবর্মন তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চালুক্যরাজ্য আক্রমণ করেন এবং চালুক্যদের রাজধানী বাদামিতে এসে উপস্থিত হল । দ্বিতীয় পুলকেশী যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারান ( ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ ) । 

( ৫ ) পরবর্তী চালুক্য রাজগণ : দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর পর থেকে চালুক্য শক্তির অবনতি ঘটতে থাকে । এই সময় দ্বিতীয় পুলকেশীর তৃতীয় পুত্র বিক্রমাদিত্য গঙ্গা বংশীয় রাজাদের সাহায্যে পল্লব আক্রমণ প্রতিহত করে পিতার রাজ্যকে পুনরুদ্ধার করেন । তিনি নরসিংহবর্মনকে বাতাপি পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেন । নিজের দুই ভ্রাতা ও অন্যান্য সামন্তদের পরাজিত করে




( ৬৫৪ - ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে ) তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন । বিক্রমাদিত্যের পর বিনয়াদিত্য ( ৬৯১ - ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দ ) এবং বিজয়াদিত্য ( ৬৯৮ - ৭৩২ খ্রিস্টাব্দ ) রাজত্ব করেন । বিনয়াদিত্য উত্তর ভারতে এক বিজয় অভিযান পাঠিয়ে ছিলেন । বিজয়াদিত্যের শাসন কালে চালুক্য রাজ্য সর্বাপেক্ষা শান্তিপূর্ণও সমৃদ্ধশালী হয় । বিজয়াদিত্যের পর বিক্রমাদিত্য ৭৩৩ থেকে ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তাঁর রাজত্ব কালে আরবগণ সিন্ধু জয় করে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য অগ্রসর হয় । কিন্তু চালুক্যগণ সাফল্যের সঙ্গে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয় । তবে বিক্রমাদিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল পল্লবদের সঙ্গে যুদ্ধ । তিনি তিনবার পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চি অধিকার করেন । দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের রাজত্ব কালে চালুক্য স্থাপত্য শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি হয় । 


দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন ৭৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । তিনিই ছিলেন বাপির চালুক্য বংশের সর্বশেষ নরপতি । এই সময় দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট নরপতি দন্তিদুর্গ প্রাধান্য বিস্তার করেন এবং রাষ্ট্রকূটগণই চালুক্য বংশের প্রাধান্য খর্ব করেন ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন