আর্যজাতি ও তাদের আদিবাসস্থান সম্পর্কে কি জান ? ভারতে আর্যদের সম্প্রসারণ সম্বন্ধে কি জান ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর আর্যজাতি ও তাদের আদিবাসস্থান সম্পর্কে কি জান ভারতে আর্যদের সম্প্রসারণ সম্বন্ধে কি জান arjojati o tader adibasosthan somporke ki jano bharote arjoder somprosaron sombondhe ki jano


উত্তর : ( ১ ) আর্যজাতি : এশিয়া ও ইয়ােরােপের সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসী একটি প্রাচীন ও সুসম্বন্ধ জাতির এবং তার ভাষার নাম আর্য । ঋকবেদে , আবেস্তা ও পারসিক শিলালিপিতে এই জাতি ও ভাষার পরিচয় পাওয়া যায় । ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে ইরান ( পারস্য) ছাড়াও পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতে আর্যগণ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । 


প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে আর্য শব্দটি জাতিগত সাধারণভাবে ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে আর্য কোন জাতির নাম নয়, ইন্দো - ইয়ােরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর নাম । ল্যাটিন , জার্মানী , গ্রীক,গথিক , সংস্কৃত, কেল্টিক ও পারসিক এই ভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । যেকোন ব্যক্তি যদি এই ভাষাগােষ্ঠীর যে কোন একটি ভাষার কথা বলেন তাহলেই তাকে আর্য বলা যেতে পারে । 


শ্বেতকায় , দীর্ঘাকৃতি, নীলনয়ন , উন্নতনামা আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে কৃষ্ণকায়, শ্যামল ও পীত জাতিকে পরাজিত করে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করে । আর্য ছাড়া অন্য সকল জাতিই তাদের নিকট অনার্য নামে পরিচিত ছিল । প্রথম আর্যরা নিজেদের গৌরবর্ণ এবং জাত্যাভিমান সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিল এবং পরাজিত অনার্যদের তারা দাস , দস্যু, নিষাদ প্রভৃতি নামে অভিহিত করত । এমন কি নিজেদের প্রভাবাধীন অঞ্চলকে তারা ‘আর্যাবর্ত’ বলে পরিচিতি দিতেই অধিকতর পছন্দ করত । কিন্তু কালক্রমে তারা অনার্যদের দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং আর্য ও অনার্যদের বিবাহের ফলে যে মিশ্রজাতির উদ্ভব হয় পরবর্তীকালে তারাই প্রাচীন ভারতে হিন্দু নামে অভিহিত হতে থাকে । ফলে আর্যদের বর্ণ ও জাতিগৌরব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে । আর্য শব্দটির অর্থও পরিবর্তিত হয় । আর্য শব্দটির নতুন অর্থ হয়ে দাঁড়ায় মানসিক গুণ আর সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা । ভাষা ও জাতিবাচক আর্য কথাটির এই নতুন গুণবাচক অর্থ ভারতের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । 

( ২ )আর্যদের আদি বাসস্থান : আর্যদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে । অনেকে মনে করেন যে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চল ছিল আর্যদের আদি বাসস্থান ভূমি । বিখ্যাত জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলার এই মতের প্রধান সমর্থক । তিনি বলেন মধ্য এশিয়ার বাসভূমি পরিত্যাগ করে আর্যদের একটি শাখা ইয়ােরােপের দক্ষিণ দিকে বসতি স্থাপন করে । অপর শাখাটি পারস্য হয়ে ভারতে প্রবেশ করে । কিন্তু এই অভিমতটি অনেকে সমর্থন করতে আপত্তি করেন । তারা বলেন যে মধ্য এশিয়া থেকে মানুষ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল একথা ঠিক, কিন্তু তাদের সংস্কৃতি এত নিম্নমানের ছিল যে তাদের পক্ষে আর্যসভ্যতার  মতাে উচ্চমানের সভ্যতা সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল । অধ্যাপক ম্যাকডােনেল ও অধ্যাপক গিল দক্ষিণ - পূর্ব ইয়ােরােপকে আর্যদের আদি বাসভূমিরূপে চিহ্নিত করেন । তাদের ধারণা ভারতীয় , গ্রীক , জার্মান ও পারসিকগণ একই অঞ্চলে বসবাস করত এবং জীবিকা হিসাবে কৃষিকার্য গ্রগ্রহণ করায় তারা আর্য নামে পরিচিত হয় আর্য শব্দের অর্থ হল কৃষি । বালগঙ্গাধর তিলকের মতে আর্যরা উত্তরমেরুতে বাস করত । কিন্তু সেখানকার জলবায়ু ধীরে ধীরে আরও ঠান্ডাহয়ে পড়ায় তারা ভারত ও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে । তিনি এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেদে বর্ণিত ছমাস দিন , ছয়মাস রাত্রির কথাও উল্লেখ করেন । বর্তমানে ভূতাত্ত্বিকগণ বিশ্বাস করেন  মেরু অঞ্চল একসময় জনবসতিপূর্ণ শস্যশ্যামল ছিল । তবুও তিলকের এই মতবাদ অনেকেই মানতে রাজি হননি । ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন দক্ষিণ রাশিয়াই ছিল আর্যদের আদি বাসস্থান । মহামহােপাধ্যায় জ্ঞাননাথ ঝা বলেন যে ব্ৰত্মর্ষিদেশ অর্থাৎ পাঞ্জাব ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল আর্যদের আদিবাসস্থান কিন্তু কিছু সংখ্যক ভারতীয় ঐতিহাসিক সপ্তসিন্ধু অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান আফগানিস্তান এবং ভারতের পাঞ্জাব , সিন্ধু কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানকে আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে চিহ্নিত করেন । আবার স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও ঐতিহাসিক পার্জিটার তিব্বতকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে অভিহিত করেন । 


 কিন্তু অধ্যাপক গাইলস ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ উপরি উক্ত মতবাদগুলাে অগ্রাহ্য করে বলেন যে , দক্ষিণ পূর্ব ইয়ােরােপে বা বল্কান অঞ্চলে অথবা ভিশচুলা নদীর তীরে আর্যরা বাস করত । বৈদিক সাহিত্যে যে সব গাছপালা ও প্রাণীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে , সেইসব গাছপালা ও প্রাণী এই অঞলেই বেশি দেখা যায় । বিশেষত ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি বােঘাজ -কোয় নামক স্থানে আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে এবং ঐ শিলালিপিতে ইন্দ্র , বরুন, মিত্র প্রভৃতি দেবতার নাম উল্লেখ থাকায় দক্ষিণ - পূর্ব ইয়ােরােপ থেকে পূর্বদিকে আর্যদের অভিযানের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় । এইসব প্রমাণ সত্ত্বেও অনেকে এই মতের বিরােধিতা করে এশিয়া মাইনরের কাপাডােসিয়াকে আর্যদের আদি বাসস্থান উল্লেখ করেন । 
 
তবে বর্তমানকালে ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনস্টাইন ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ঋকবেদের আর্যদের আদিবাসস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেন । তাঁর মতে আর্যরা আদিতে রাশিয়ার ইউরাল পর্বতমালার দক্ষিণ দিকে কিরখিজ অঞ্চলে বসবাস করত । কিরখিজের স্তেপ অঞ্চল থেকে তারা ক্ৰমে পারস্য ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে । ব্রান্ডেনস্টাইনের এই মতটি বেশিরভাগ পন্ডিত গ্রহণ করায় আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে এই অভিমতটি বেশি প্রচলিত হয়েছে । 


( ৩ ) আর্যদের সম্প্রসারণ : আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য ঋকবেদ । ঋকবেদে উল্লিখিত বিভিন্ন স্তোত্র থেকে আর্যদের বাসস্থানের ভৌগােলিক নাম বর্ণনা পাওয়া যায় । ঋকবেদ ছাড়াও পরবর্তী সংহিতাগুলাে , ব্রাত্মণ ও আরণ্যক সমূহে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে অনুমান করা যায় যে ১৫০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে বিস্তার সম্ভব হয় । তবে আর্যদের কোন বিশেষ দল বা গােষ্ঠীর দ্বারা এই বিস্তার ঘটেনি । দীর্ঘকাল ধরে আর্যদের বিভিন্ন গােষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করেছে । এই গােষ্ঠীগুলাে অনার্যদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করে ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বসতি বিস্তার করে । ভারতে প্রবেশ করে আর্যরা প্রথম সিন্ধু নদীর উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে । বৈদিক সাহিত্যে ‘সপ্তসিন্ধু’ কথাটির উল্লেখ দেখা যায় । এই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলই ভারতে আর্যদের প্রথম বাসস্থান । আফগানিস্তান ও পাঞ্জাবের  মধ্যবর্তী সিন্ধু


ও তার শাখা -প্রশাখা সম্বলিত সাতটি নদীর অববাহিকা অঞ্চল নিয়ে সপ্তসিন্ধু গঠিত ছিল । সংক্ষেপে বলা যায় যে এই সময় সিন্ধু নদ ও শাখা প্রশাখা বিধৌত পাঞ্জাব আৰ্যসভ্যতার কেন্দ্রস্থল ছিল । ঋকবেদের যুগে এই অঞ্চলে শিবি ও পুরুজাতি বাস করত । কিছুদিনের মধ্যেই তারা পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে থানেশ্বর ও তার নিকটবর্তী সমতলভূমিতে পদার্পণ করে । গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতী , দৃশদ্বতী , গােমতী , সরযু প্রভৃতি নদী ও মধ্য ভারতের অধিবাসী বিভিন্ন আর্যগােষ্ঠীর উল্লেখ ঋকবেদে দেখা যায় । তবে এই যুগে আর্যরা বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করেনি বলে মনে হয় । 
যজুর্বেদ ও অথর্ববেদের যুগে আর্যরা পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে । এই যুগে গাঙ্গেয় উপত্যকা সম্পূর্ণ ভাবে আর্যদের অধিকারে চলে যায় । আরণ্যক ও উপনিষদগুলােতে আর্যদের ক্রমিক বিস্তারের চিত্র আরও স্পষ্ট । সমগ্র ভারতবর্ষ সেই সময় মধ্যাঞল ( মধ্যদেশ ), উদীচ্য (উত্তরাপথ ), প্রাচ্য (পূর্বভারত ), দক্ষিণাপথ (দাক্ষিণাত্য ) এবং অপরান্ত ( পশ্চিম ভারত ) এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি অখন্ড ভৌগােলিক রুপ গ্রহণ করে । এদের মধ্যে মধ্যাঞলটি ছিল আর্যসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র । কুরু, পাঞ্জাল উশীনর প্রভৃতি প্রধান প্রধান আর্যগােষ্ঠীগুলাে এখানে বাস করত । মধ্যদেশ আর্যাবর্ত নামেও পরিচিত ছিল । ব্রাত্মণ্যশাস্ত্রে বর্ণিত আর্যদের বাসভূমি অথবা বৌদ্ধশাস্ত্রকারদের আর্যাবর্ত সম্পর্কে পতঞ্জলির মহাভাষ্য ছাড়া ধর্মসূত্রেও ধর্মশাস্ত্রে বলা হয় যে পশ্চিম দিকে সরস্বতী নদী যেখানে বিলুপ্ত হয়ে যায় , পূর্বদিকে যেখানে নিবিড় অরণ্যানী শুরু হয় এবং উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ এবং দক্ষিণে পরিপত্র ( বিন্ধ্য পর্বতের একটি অংশ ) পর্বতের অন্তর্বর্তী অঞ্চলই আর্যবর্ত নামে পরিচিত । পূর্বাঞ্চলের বা প্রাচ্যের কাশী , কোশল , বিদেহ প্রভৃতি আর্যজনপদগুলাের সঙ্গে , অঙ্গ , মগধ ,পুন্ড্র প্রভৃতি অনার্য দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে । তবে দক্ষিণ ভারতের  আর্যদের অনুপ্রবেশ তখনও ঘটেনি ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন