খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম উত্থানের পিছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলাে বিশ্লেষণ কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম উত্থানের পিছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলাে বিশ্লেষণ কর khrishtopurba shoshto shotabdite boudhodhormo uthaner pichone samajik o arthonoitik karongulo bishleshon koro questions answers


উত্তর :( ১) ধর্মীয় আন্দোলনের পটভূমি : বৈদিক যুগে আর্যদের সামাজিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ ও সরল । কিন্তু পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন বসতিস্থাপন , অনার্যজাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ - প্রকৃতির ফলে আর্যদের সামাজিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয় । এই সব পরিবর্তনের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে  ব্রাহ্মণ ধর্মের বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রতিবাদ সৃষ্টি হয় এবং খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় । 


( ২ ) সামাজিক কারণ : সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা দেয় শ্রম প্রথা বর্ণা । সাধারণ মানুষের পক্ষে যােগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী জীবনের বৃত্তি গ্রহণ করা আর সম্ভব ছিল না । বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সামাজিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনও নিষিদ্ধ হয় । ফলে বর্ণভেদ প্রথা কঠোর জাতিভেদ প্রথায় পরিণত হয় এবং মানুষে মানুষে বিভেদের পথ সৃষ্টি হয় । সামাজিক ক্ষেত্রে স্ত্রীজাতির সম্মান ও অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার ফলেও প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয় । অপরদিকে এই যুগে ব্রাত্মণ-ক্ষত্রিয় জোট ও শূদ্র সমাজ - বৃত্তের দুই মেরুতে অবস্থান করলেও বৈশ্য এবং শূদ্রের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশই হ্রাস পেতে থাকে । অনেক সময় বৈশ্য ও শূদ্র মিলিতভাবে ব্রাত্মণ-ক্ষত্রিয়দের নীতির বিরােধিতা করতে শুরু করে । তাছাড়া আর্যসমাজে আদিবাসী অনার্যদের অন্তর্ভুক্তির ফলে শূদ্রের সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পূর্বের মতাে শূদ্রদের অগ্রাহ্য করা আর সম্ভব ছিল না । তাছাড়া কৃষিকার্য এবং ব্যবসা - বাণিজ্যের লিপ্ত বৈশ্যগণ প্রচুরভূ-সম্পদ ও নগদ অর্থের মালিক হিসাবে সমাজে ‘শ্রেষ্ঠী’ নামে পরিচিত হয় । এই সময় রাজাদের ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পাওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় । কিন্তু অপরদিকে ব্রাক্ষ্মণগণ সমাজে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করতে শুরু করে । ব্রাহ্মণদের এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ তৎপর হয়ে ওঠে । প্রসঙ্গ ক্রমে বলা যায় যে গৌতমবুদ্ধ ও মহাবীর দুজনেই ছিলেন ক্ষত্রিয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । ঐতিহাসিক আর . এস . শর্মার মতে “ The Kshatriya reaction against the domination of the priestly class called Brahmanas who claimed various privilages was one of the causes of new religion .” আবার বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উদ্ভবের পর অধিকাংশ রাজারা এবং প্রভাবশালী বৈশ্যগণ গৌতমবুদ্ধ ও মহাবীরের অনুরাগী হয়ে ওঠে ।

( ৩ ) অর্থনৈতিক পরিবর্তন : অর্থনৈতিক পরিবর্তন প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনগড়ে ওঠার পথ প্রস্তুত করে । ঐতিহাসিক রােমিলা থাপার বলেন , “সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তনগুলাে যথা , নগরসমূহের উদ্ভব কারিগর শ্রেণীর প্রভাব এবং শিল্প বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তার প্রভৃতি ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ।” খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে কৃষির বিকাশ ঘটে । জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য লােহার তৈরি ভারী লাঙল ব্যবহৃত হতে শুরু করে । জমিতে জলসেচ ও সারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে আরম্ভ হয় । ইতিমধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে নগরীর পত্তন শুরু হলে উদ্বৃত্ত ফসল ছাড়াও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের অন্তর্দেশীয় বাজারের আয়তন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় । ব্যবসা - বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনিময় ব্যবস্থার পরিবর্তে খােদিত - মুদ্রা এর প্রচলন এলে ব্যবসা -বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন দেখা যায় । এই যুগে বহির্বাণিজ্যেরও সূচনা হয় । ফলে আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধ বৈশ্যগণ সমাজে একটি প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী হিসেবে দেখা এবং বৈদিক ধর্মের নানারূপ বাধা নিষেধের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য তারা সচেষ্ট হয়ে ওঠে । 


( ৪ ) রাজনৈতিক কারণ : পরবর্তী বৈদিক যুগে রাষ্ট্রের আয়তন ও ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ক্ষত্রিয়গণ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে । সামরিক শক্তির ক্রমােন্নতি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ রাজাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে । সুতরাং তারা স্বাভাবিকভাবেই পুরােহিত ব্রাত্মণদের প্রাধান্য রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না । সামাজিক ক্ষেত্রে ব্রাত্মণগণ যে বিশেষ সম্মান ভােগ করতেন ক্ষত্রিয়গণ তাও স্বীকার করতে আপত্তি করতে শুরু করে । তাদের এই বিরােধিতার ফলে ব্রাত্মণ ও ক্ষত্রিয়দের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষত্রিয়দের নেতৃত্বেই প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন গড়ে ওঠে ।



( ৫ ) ধর্মীয়কারণ : বৈদিক যুগের শেষ দিকে থেকেই বৈদিক ধর্ম, কতকগুলাে জটিল - ব্যয়বহুল প্রাণহীন যাগ যজ্ঞ ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিণত হয় । বিভিন্ন ধরণের অসংখ্য পশুবলি এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গে পরিণত হয় । আচার - অনুষ্ঠান সর্বস্ব এই ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাণের কোন সম্পর্ক ছিলনা । তাছাড়া অর্থনৈতিক কারণেই বৈশ্য ও শূদ্র সম্প্রদায় পশুবলি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে । অপর দিকে এইসব জটিল যাগ -যজ্ঞ ও পূজার্চনা করার জন্য একটি - অভিজ্ঞ পুরােহিত শ্রেণীর উদ্ভব হয় । ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জটিল রীতিনীতির জন্য পুরােহিতদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় এবং তাদের দাবিও ক্রমশ অত্যাচারে পরিণত হয় । এই পুরােহিত শ্রেণীর নেতৃত্বে পশুবলি , জীবহিংসা এবং মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা ধর্মের অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে । ফলে মানুষের স্বাভাবিক ধর্মজ্ঞান , বিচারবুদ্ধি ও মানবপ্রীতি প্রচলিত ধর্ম ও তার অনুষ্ঠানের নীচে চাপা পড়ে যায় । স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তাশীল মানুষেরা এই শােচনীয় অবস্থার হাত থেকে প্রকৃত ধর্মকে পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টাকরতে শুরু করেন । কিন্তু উপনিষদে বর্ণিত আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনা ও তত্ত্বাদি জনসাধারণের বােধগম্য হত না । এমনকি পুরােহিত শ্রেণীও উপনিষদের শিক্ষা জনসাধারণের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না । স্বাভাবিকভাবেই চিন্তাশীল মানুষেরা এই শােচনীয় অবস্থার হাত থেকে প্রকৃত ধর্মকে পুণরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টাকরতে শুরু করেন । চিন্তা ভাবনা নতুন ধর্ম ও দর্শনের রূপ গ্রহণ করে । বিশেষত শহরগুলােতে পুরাতন ও নতুনের মধ্যে যে সংঘাত দেখা দেয় তা এই দার্শনিক চিন্তার ভিত্তিকে আরও দৃঢ়করে তােলে । 


( ৬ ) সংগঠিত প্রতিবাদ : প্রচলিত সামাজিক অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যেকার ধূমায়িত অসন্তোষ ধীরে ধীরে সংগঠিত ও প্রতিবাদের রূপ গ্রহণ করে । বৈদিক ধর্ম ও ব্রাত্মণ সংস্কৃতি ছিল তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য । আগের যুগের তপস্বী ও ভ্রাম্যমান তার্কিকের দল নতুন নতুন চিন্তার ও দার্শনিক ভাবনার একটি ঐতিহ্যগড়ে তুলেছিল । এই সব দার্শনিকদের মধ্যে নিয়তিবাদী আজীবিক ও জড়বাদী চার্বাকদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য । কিন্তু জীবিকার জন্য ধর্মের ওপর নির্ভরশীল পুরােহিত সম্প্রদায় এইসব দার্শনিকদের প্রচণ্ড বিরােধিতা করতে শুরু করেন । তা সত্ত্বেও বহু মুনি ঋষি এই প্রতিবাদকে বিচ্ছিন্নভাবে ধ্বনিত করে তুলতে থাকেন । উপনিষদের স্বাধীন ধর্মচিন্তা তাদের নতুন পথের সন্ধান দেন । বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবের প্রাক্কালে দীর্ঘনিকায় সূত্রে ৬২ টি প্রতিবাদী ধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে যে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবের ফলে এইরূপ ৬২ টি প্রতিবাদী ধর্মমতের সন্ধান পাওয়া যায় । জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম ছিল তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়। এই সব ধর্মমতে সরল অনাড়ম্বর ধর্ম আচরণ , পুরােহিত শ্রেণীর প্রাধান্য অস্বীকার , বৈষম্য ও জাতিভেদহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, অস্পৃশ্যতা বর্জন প্রভৃতি বিষয়ের কথা বলা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ সহজেই এই সব ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হয় ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন