উত্তর : ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল সাধারণত উপজাতিকেন্দ্রিক । ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা ভরত , সৃঞ্জয়,অনু , পুরু, দুহ্য , তুর্বশ প্রভৃতি গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক গােষ্ঠীই আলাদা আলাদাভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল । ঋকবেদের পরিবার ছিল রাষ্ট্রের সর্বনিম্নস্তর । পিতা , মাতা ,পিতামহ , ও পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে পরিবার গঠিত হত । রক্তের সম্পর্কের দ্বারা পরিবার বন্ধন স্থির করা হত এবং কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি কুলগঠিত হত । কুলের প্রধানকে কুলপতি বা কুলাপ বলা হত । কয়েকটি কুল একটি গ্রামে বাস করত এবং গ্রামের প্রধানকে বলা হত গ্রামীণ । কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি জন গঠিত হত এবং জনের শাসনকর্তা গােপন বলা হত । কয়েকটি গােপ নিয়ে একটি বিশ গঠিত হত । বিশের শাসনকর্তা বিশপতি বা রাজন উপাধি লাভ করত ।
ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে সবসময়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত । তাছাড়া আর্য - অনার্য গােষ্ঠীর মধ্যেও নানাকারণে যুদ্ধ বিগ্রহ দেখা দিত । সাফল্যের সঙ্গে সব যুদ্ধ এই পরিচালনা করার ফলে গােষ্ঠীপতির ক্ষমতা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে । রােমিলা থাপারের মতে ঋকবেদের রাজারা ছিল প্রধানত যােদ্ধাদের নেতা । তবে শান্তির সময়ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব গােষ্ঠীপতির বা রাজার পালন করতে হত । সংক্ষেপে বলা যায় যে যুদ্ধে দক্ষতা ও গােষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কাজের সাফল্যের ওপর রাজার অস্তিত্ব নির্ভর করত । রাজা রাজ্যের অধিবাসীদের স্বেচ্ছায় প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করতেন । যুদ্ধে পরাজিত শত্রুর সম্পদ এবং লুষ্ঠিত সামগ্রীর একাংশ তিনি লাভ করতেন । ‘বলি’ নামক একপ্রকার করও তিনি গ্রহণ করতেন ।
রাজাই রাজ্যের কর্ণধার । ঋকবেদে বহু রাজার নাম পাওয়া যায় । কোথাও কোথাও রাজাকে সম্রাটও বলা হয়েছে । ঋকবেদে বর্ণিত দশরাজার কাহিনী থেকে জানা যায় যে রাজা দিবােদাসের পুত্র রাজা সুদাস ছিলেন ভরত গােষ্ঠীর রাজা । তার পুরােহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র কিন্তু সুদাস এই পুরােহিতের কাজে সন্তুষ্ট না হয়ে বশিষ্ঠকে প্রধান পুরােহিতের পদে নিযুক্ত কিন্তু করেন । এজন্য বিশ্বামিত্র ক্ষুব্ধ হয়ে দশটি আর্য উপজাতির রাজাদের নিয়ে দশ রাজার জোট গঠন করে রাজা সুদাসকে আক্রমণ করেন । এই যুদ্ধে কিছু অনার্য রাজাও যােগ দেন । বহু বাধা - বিপত্তি অতিক্রম করে সুদাস এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন ।
ঋকবেদের যুগে রাজপথ সাধারণভাবে বংশানুক্রমিক ছিল । তবে সম্ভবত কোন কোন রাজ্যে নির্বাচিত রাজতন্ত্রও প্রচলিত ছিল । বিশ বা গােষ্ঠী নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করত । অভিষেক প্রথার দ্বারা রাজাকে সাধারণ মানুষ থেকে স্বতন্ত্র এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ঘােষণা করা হত । পুরােহিত রাজার অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করতেন । এইভাবে রাজার এবং রাজা ও রাজপুরােহিত একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা ও সম্মান ভােগ করতেন । ঋকবেদে রাজাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী বলা হলেও তার সার্বভৌম অধিকার রক্ষার জন্য জনসমর্থন লাভের কথা বলা হয়েছে ।
ঋকবৈদিক যুগে রাজার প্রধান কাজ ছিল শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে দেশ রক্ষা , প্রজাদের ধন ও প্রাণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং দেশের আইন - শৃঙ্খলা বজায় রাখা । তবে রাজকার্য পালনের ব্যাপারে গ্রামের প্রধান ব্যক্তিরা রাজাকে সাহায্যে করতেন । কুলের শাসনকর্তা থেকে শুরু করে জন -এর শাসনকর্তা পর্যন্ত সকলেই শাসনকার্যের ব্যাপারে রাজাকে সাহায্য করতেন । রাজার দুজন খুব ঘনিষ্ঠ কর্মচারী ছিলেন পুরােহিত ও সেনানী । পুরােহিত ধর্মীয় কাজ ছাড়াও জ্যোতিষী ও পরামর্শদাতার কাজও করতেন । সেনানী পদাতিক , অশ্বারােহী ও রথারােথীর দ্বারা গঠিত সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার দায়িত্বপালন করতেন । অনেক সময় রাজা স্বয়ং, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে সৈন্য পরিচালনা করতেন । রাজার অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে গুপ্তচর, সংবাদ সংগ্রাহক এবং দূতের উল্লেখ দেখা যায় । কিন্তু এই সব কর্মচারীদের কে কি দায়িত্ব পালন করবে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না ।
তবে ঋকবৈদিক যুগে রাজা রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা অধিকারী হলেও তার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযােগ ছিল না । ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামে দুটি সংস্থা রাজার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট সুযােগ ভােগ করত । সম্ভবত প্রভাবশালী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের নিয়ে সভাগঠিত হত আর সমিতি ছিল জনসাধারণের পরিষদ । সম্ভবত সভা ও সমিতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাজা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন । তবে সভা ও সমিতি কিরূপ ক্ষমতা ভােগ করত তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে সভা অপেক্ষা সমিতি অধিকতর ক্ষমতাশালী ছিল ।
( ২ ) পরবর্তী বৈদিক যুগের পরিবর্তন : পরবর্তী বৈদিক যুগে পূর্ব ভারতের দিকে আর্যবসতি বিস্তারের ফলে বৃহৎ রাজ্য গড়ে ওঠে । কাশী , কোশল , বিদেহ বৎস , মথুরা প্রভৃতি রাজ্য এই যুগে গড়ে ওঠে । বৃহৎ রাজ্যগুলাের মধ্যে একছেত্র ক্ষমতা লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করতেন । ফলে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয় । বিজয়ী রাজারা রাজা ‘বিশ্বজনীন’ , ‘সার্বভৌম’ , ‘বিরাট’ , ‘একরাট’ , ‘সম্রাট’ প্রকৃতি উপাধি গ্রহণ করতেন । ঋকবৈদিক যুগে কয়েকটি রাজা পূর্বগৌরব হারায় এবং কুরু, পাঞ্জাল , বৎসু, কাশী প্রভৃতি শক্তিশালী রাজ্য গড়ে ওঠে ।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা কয়েকটি কারণে বৃদ্ধি পায় । (ক ) বৃহত্রাজ্য গড়ে ওঠার ফলে উপজাতিক যুগ অপেক্ষা রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । (খ ) বিভিন্ন উপজাতির যুদ্ধ ও রাজ্যবিস্তারের জন্য যুদ্ধের ফলে রাজার ক্ষমতা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে । ( গ) রাজা তার কর্মচারীদের সাহায্যে তার ক্ষমতা আরও বৃদ্ধিকরার চেষ্টা করেন । (ঘ ) ঋকবৈদিক যুগের পরবর্তী বৈদিক যুগে কোথাও কোথাও নির্বাচিত রাজতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও রাজতন্ত্র সাধারণত বংশানুক্রমিক ছিল । বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি হতে সাহায্য করে । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে রাজাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার বিশ্বাসী রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে । রাজাকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে প্রচার করা হয় । রাজা তখন থেকেই অভ্রান্ত এবং সকল প্রকার শাস্তির উর্ধ্বে বলে স্বীকৃতিলাভ করেন । রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণকারী ‘ সভা ’ ও ‘সমিতি ’ পূর্বেকার ক্ষমতা অনেকাংশে হারায় । যদিও এই দুটি সংস্থাকে একেবারে উপেক্ষা করা রাজার পক্ষে সম্ভব ছিল না । পূর্ববর্তী যুগের মতে এই যুগেও রাজ্যশাসন , প্রজাপালন , যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব রাজার প্রধান কর্তব্য বলেই বিবেচিত হত ।
রাজার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধির ফলে রাজা নতুন নতুন রাজকর্মচারী নিয়ােগ করার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেন । পুরােহিত ও সেনাপতি ছাড়া ‘রন্তিন’নামে এক জাতীয় অভিজাত কর্মচারী রাজাকে শাসনকার্যের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন । সুত বা রথচালক , সংগ্রহত্রী বা কোষাধ্যক্ষ ভাগদুখ বা রাজস্ব সংগ্রাহক প্রভৃতি কর্মচারী ছিল । রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে গুপ্তচরদের সংখ্যাও বৃদ্ধিকরা হয় । এছাড়া রাজসভায় ক্ষত্রী , অক্ষবাপী বা পাশা খেলার সঙ্গী থাকত ।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা আইনত নিরঙ্কুশ হলেও কার্যত প্রজাপালন ও ন্যায় বিচার স্থাপন তার প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হত । অভিষেকের সময় রাজা অঙ্গীকার করতেন যে তিনি ব্রাত্মণ ও গােধন রক্ষা করবেন এবং জনহিতকর কাজ করবেন ।তাছাড়া প্রজাদের মতামত উপেক্ষা করে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভবছিল না । অর্থব বেদে রাজা এবং প্রজাদের মধ্যে সদ্ভাবই সুশাসনের বৈশিষ্ট্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে । তৎকালীন সাহিত্য থেকে জানা যায় যে সৃঞ্জয় উপজাতির অত্যাচারী রাজাকে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । এই সব ঘটনা থেকে মনে হয় যে রাজা প্রভুত ক্ষমতার অধিকারী হলেও তারপক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার কোন সুযােগ ছিল না ।