সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রধান কারণগুলাে কি ছিল ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রধান কারণগুলাে কি ছিল sindhu sobvota dhongsher prodhan karongulo ki chilo questions answers


উত্তর : ( ১ ) সিন্ধুসভ্যতার অবক্ষয় :  প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শালের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার স্থায়িত্বকাল কিন্তু সম্প্রতি ঐতিহাসিকেরা এরূপ সিদ্ধান্ত করেছেন যে খ্রিস্টপূর্ব ষােড়শ  শতাব্দী পর্যন্ত হরপ্পা সংস্কৃতি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল । কিন্তু কি করে যে এই উন্নত সভ্যতা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল এবং এই সভ্যতার নিদর্শনগুলাে লােকচক্ষুর অন্তরালে প্রাপ্ত সীলমােহর গুলাের পাঠোদ্ধার সম্ভব না হবে যতদিন পর্যন্ত সিন্ধু অঞ্চলের সভ্যতার ধ্বংসের কারণ প্রধানত অনুমানের ওপরই নির্ভরশীল থাকবে । সিন্ধুসভ্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন গবেষণা ও ঐ অঞ্চলে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের সম্ভাব্য কারণ অনুমান করা হয়েছে । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসের কারণ নির্ণয় করতে হলে প্রথমেই হরপ্পা সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলাে বিশদভাবে জানতে হবে । অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে যে এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নগরীগুলাের জীবনে কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায় ছিল এবং হরপ্পা সংস্কৃতির চরম উন্নতি ঘটার পর এর অবক্ষয় শুরু হয় । এই অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পা এই দুটি শহরে খননকার্যের ফলে । খননকার্যে ফলে যেসব জিনিসপত্র ও তথ্য প্রমাণ মিলেছে তা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে , এ যুগে মহেঞ্জোদারােতে প্রাপ্ত সাতটি স্তরের মধ্যে সর্বোপরিস্তরে দেখা যায় যে বস্তির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি  , পুরাতন ও পরিত্যক্ত ভিত্তির ওপর নতুন গৃহ নির্মাণ এবং অতিরিক্ত লােকের বসবাসের জন্য প্রশস্ত কক্ষগুলােকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বন্টন । তাছাড়া কোথাও কোথাও দেখা যায় যে বাড়িগুলাে বে - আইনীভাবে রাজপথের একাংশ অধিকার করে নিয়েছে । জলসরবরাহ ব্যবস্থাও এই সময় মেরামতির অভাবে অকেজো হয়ে পড়তে শুরু করে । পূর্বেকার যুগের তুলনায় ব্যবসা - বাণিজ্যেরও যে অবনতি ঘটেছিল এই সময়ের মৃৎপাত্রের উপাদানের মান এবং নির্মাণ কৌশল দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় । পাত্রের অলঙ্করণের কাজেও নিম্নমানের পরিচয় পাওয়া যায় । হূইলার মন্তব্য করেন যে , পরবর্তীযুগের মহেঞ্জোদারাে এবং সম্ভবত হরপ্পাও পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় দরিদ্র ও হতশ্রী হয়ে পড়েছিল । 
 

( ২ ) প্রাকৃতিক পরিবর্তন : সিন্ধু অঞ্চলের শহরগুলাের পতনের কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেন নি । তবে তাঁদের অনেকেই মনে করেন যে জলবায়ুর পরিবর্তন , বৃষ্টিপাতের অভাব , কৃষিজমির লবণতা বৃদ্ধি , বন্যা , ভূমিক্ষয়, রাজপুতানার মরুভূমির সম্প্রসারণ , সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তন এবং বৈদেশিক আক্রমণ সিন্ধু সভ্যতার কারণরূপে দেখা যায় । 


জলবায়ুর পরিবর্তন সিন্ধুসভ্যতা পতনের কারণ বলে অনেকেই মনে করেন । একসময় সিন্ধু অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত এবং সেখানে বাঘ , বাইসন , হাতি , মহিষ গন্ডার প্রভৃতি প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় । ধীরে ধীরে অঞ্চলের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং মাটিতে লবণের পরিমাণ দারুনভাবে বেড়ে যায় । এইরূপ প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে রাজপুতানার মরুভূমি ধীরে ধীরে ঐ অঞলের ভূমি গ্রাস করতে শুরু করে । প্রাকৃতিক এই পরিবর্তনের ফলে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয় এবং শহরগুলাের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে । 



জলবায়ুর পরিবর্তনের সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে হুইলার বলেন যে , সিন্দু অঞ্চলের নগরগুলােতে গৃহ নির্মাণের জন্য প্রচুর আগুনে পােড়া ইটের দরকার দেখা দেয় । ইট পােড়াবার জন্য স্থানীয় জঙ্গল থেকে যথেচ্ছ বৃক্ষছেদনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় । ব্যাপক বৃক্ষছেদনের ফলে বৃষ্টিপাত খুব কমে যায় । তাছাড়া সিন্দু অঞ্চলে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রেখে চাষ - আবাদ করা হত । পরবর্তীকালে মেরামতির অভাবে বাঁধগুলাে ধ্বংস হয়ে যায় এবং জলের অভাবে কৃষিকার্য ছাড়া বনাঞ্চলেরও খুব ক্ষতি হয় । 

 
( ৩ ) ভূমিকম্পের প্রকোপ : অনেকে মনে করেন যে ভূমিকম্পের ফলে সিন্ধু অঞ্চলের নগরগুলাে ধ্বংস হয় । মহেঞ্জোদারােতে যে নরকঙ্কালগুলাে পাওয়া গিয়েছে সেগুলাে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে তাদের সৎকার করা হয়নি । অনেকগুলাের গায়ে ক্ষত চিহ্ন দেখা যায় । সম্ভবত ভূমিকম্পে নগর বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে এই সব মানুষগুলাের মৃত্যু ঘটেছিল । কিন্তু ভূমিকম্প সম্পর্কিত এই মতবাদের সমালােচনা করে অনেকে বলেন যে ভূমিকম্পের ফলে এই অঞ্চলের নগরীগুলাে ধ্বংস হয়েছিল এমন কোন প্রমাণ সেখানে পাওয়া যায়নি । ডক্টর শাঙ্খালিয়া মনে করেন যে মহেঞ্জোদারাের অধিবাসীরা শহর ধ্বংস হওয়ার পর আবার নতুন স্তরে শহর পুনর্নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিল , সুতরাং ভূমিকম্পে শহর ধ্বংস হওয়ার পরও আবার নতুন করে শহর তৈরি করতে পারত । সেজন্য বর্তমানে অনেকেই ভূমিকম্পতত্ত্বকে সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের কারণ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে । 



( ৪ ) বন্যার প্রকোপ : সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে অনেকে সিন্ধুনদের বন্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন । সিন্ধুনদী পলি জমে নদীর খাত ক্রমেই উঁচু হতে শুরু করে । এর ফলে বর্ষার সময় নদীর জল কূল অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করতে থাকে । নদীর বন্যার হাত থেকে মহেঞ্জোদারাে নগরী রক্ষার জন্য আগুনে পােড়ানাে ইটের ব্যাপক ব্যবহার , অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভিত্তির ওপর বাড়ি-ঘর নির্মাণ , বাড়ি ঘরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন ভাবে উঁচু করে ক্ৰম পয়ঃপ্রণালি তৈরি প্রভৃতি থেকে বন্যার প্রকোপের পরিচয় পাওয়া যায় । এই সকল নির্দশন থেকেও একথা প্রমাণিত হয় যে বন্যার তান্ডবে মহেঞ্জোদারাে শহর ধ্বংসহয়েছিল । লােথালেও বন্যার চিহ্ন দেখা যায় । সুতরাং এই দুটি শহর ধ্বংসের জন্য বন্যার কারণ বড় ছিল তা বলা যায় । কিন্তু হরপ্পা এবং অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে বন্যার তত্ত্ব প্রযােজ্য নয় । এইচ ,ডি ,শাখালিয়াস মতে কালিবাঙ্গনে ঘর্ঘরা নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই শহর ধ্বংস হয় ।
 

( ৫ ) সিন্ধু সভ্যতার মৌলিক পরিবর্তন : সিন্ধু অঞ্চলের সভ্যতার মৌলিক পরিবর্তনকেও অনেকে এই সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেন । সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল, 
নতুন কোন পরিবর্তনকেই তারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না । কিন্তু এই সভ্যতার বিশাল ব্যপ্তির ফলে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে অন্যান্য সভ্যতার সংঘাত অনিবার্যভাবেই দেখা দেয় । বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনগ্রসর বহু মানুষ এই সভ্যতার পরিসরের অন্তর্ভুক্ত হয় । স্বভাবতই এর ফলে হরপ্পা সংস্কৃতিতে ভিন্ন সংস্কৃতি , অনুপ্রবেশ ঘটে এবং হরপ্পা সংস্কৃতি দূর্বল হয়ে পড়ে । সেজন্য অনেকের মতে অভ্যন্তরী ঘটনাবলীই ছিল হরপ্পা সভ্যতা পতনের প্রধান কারণ । কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপে বিশেষত লােথালে এই অবক্ষয়ের লক্ষণগুলাে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে । এই বন্দর নগরটি অভ্যন্তরীণ নানা সঙ্কটের সম্মুখীন হয় এবং হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাের সঙ্গেও এর যােগসূত্র ছিন্ন হয়ে পড়ে । হরপ্পা সভ্যতার শেষের দিকে কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে একটি নতুন সভ্যতার অভ্যুদয়ের ফলে পুরাতন সভ্যতার বিলুপ্তির পথ প্রস্তুত হয় । সম্ভবত লােথাল ছাড়া অন্যান্য নগরীগুলােতেও এই পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল । 

 
( ৬ ) বিদেশীদের আক্রমণ : সিন্ধু সভ্যতার অবক্ষয়ের যুগে বিদেশী বিভিন্ন জাতি ও উপজাতিদের অনুপ্রবেশ এই অঞ্চলে ঘটতে শুরু করে । হরপ্পাকে বিদেশী আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কয়েকটি দুর্গকে যে শক্তিশালী করে তােলা হয়েছিল তারও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারােতে আবিষ্কৃত ব্যাপক হত্যাকান্ডের চিহ্ন এবং রাস্তার ওপর পড়ে থাকা মানুষের অস্থি -কঙ্কাল প্রমাণ করে যে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েই এরা নিহত হয়েছিল । খননকার্যের দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে একাধিক উপজাতি সিন্ধু অঞলে প্রবেশ করেছিল । সম্ভবত বিদেশী জাতিদের আক্রমণে সিন্ধু অঞলের নগরীগুলাে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত অশ্বারােহী ও লৌহাস্ত্রে সজ্জিত আর্যগণ সিন্ধু অঞলের সভ্যতাকে ধ্বংস করে । সম্ভবত আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বে আর্যরা সিন্ধু অঞলের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হয় । ঋকবেদে উল্লেখ করা হয় যে দেবতা ইন্দ্র পুর অর্থাৎ দুর্গ ধ্বংস করে পুরন্দর উপাধি লাভ করে । এই দুর্গগুলাে নিঃসন্দেহে সিন্ধু অঞলে অবস্থিত ছিল । বৃষ্টিপাতের অভাব ও বন্যার ফলে সম্ভবত শেষ পর্যন্ত মহেঞ্জোদারাে নগরীটি পরিত্যক্ত হয় । পরে সমগ্র ভূভাগই জনবসতিহীন হয়ে পড়ে । 



( ৭ ) উপসংহার : উপসংহারে বলা যায় আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে সুনির্দিষ্ট একটি কারণে সিন্ধু অঞলের শহরগুলাের পতন ঘটেনি ।বিভিন্ন শহরের পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল । তাছাড়া আর্যজাতির আক্রমণেই যে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিল তা প্রমাণ করার মতো কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি । তাদের অকস্মাৎ এই সভ্যতা ধ্বংস হয় সে কথা মেনে নিতেও অনেকেই সম্মত নন । তাদের মতে অভ্যন্তরীন বিপর্যয়ই এই সভ্যতাকে ধ্বংসসান্মুখ করে তােলে এবং ধীরে ধীরে এই সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটে ।


 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন