কিভাবে রাজরাজ ও রাজেন্দ্র চোল একটি নৌসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর কিভাবে রাজরাজ ও রাজেন্দ্র চোল একটি নৌসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল kivabe rajraj o rajendra chol akti nousamrajya gore tulechilo questions answers


উত্তর : চোল নৌবাহিনী গঠন : চোলরাজ প্রথম পরান্তক চোলরাজবংশে মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করলেও খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর শেষ দিকে রাজরাজ চোলের সিংহাসন প্রাপ্তি থেকে চোল সাম্রাজ্যের প্রকৃত গৌরবের সূচনা হয় । রাজরাজের ত্রিশ বছরের রাজত্বকালে ( ৯৮৫ - ১০১৪ খ্রিস্টাব্দ ) চোলরাজতন্ত্রের গঠনকাল বলা যায় । সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি শাসনব্যবস্থাকে নতুন করে গঠন করেন এবং একটি শক্তিশালী সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী গড়ে তােলার ব্যবস্থা করেন । এই সময় ভারতের সুদূর দক্ষিণ দিকে আরও দুটি প্রধান শক্তি ছিল পাণ্ড্য ও কেরল । আবার এই দুটি রাজ্যই নৌশক্তিতে যথেষ্ট বলীয়ান ছিল । ভৌগােলিক দিক থেকে ভারত উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত না হলেও রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সিংহল ( শ্রীলঙ্কা ) এর সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ । দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে আকস্মিকভাবে চোলদের অভুত্থানের ফলে দক্ষিণ - পশ্চিম ভারতের রাষ্ট্রকূট ও চালুক্যদের মতাে পাণ্ড্য , কেরল ও সিংহলও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং এই তিনটি শক্তি একযােগে চোলদের বিরােধিতা করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে । দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ভারসাম্য অক্ষুন্ন রাখাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য । 


অপর দিকে রাজরাজ চোল প্রতিপক্ষের শক্তি চূর্ণ করে দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতি শুরু করেন । সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলের অদিবাসীদের সাহায্যে তিনি একটি বিরাট নৌবাহিনী গঠন করার ব্যবস্থা করেন । সামুদ্রিক অভিযানে সুদক্ষ মৎসজীবীদের তিনি সামরিক শিক্ষার শিক্ষিত করে তুলে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন ।  গভীর বনাকীর্ণ তামিল অঞ্চলে নৌবহর তৈরি করার উপকরণের কোন অভাব ছিল না । তাছাড়া সমুদ্রের তীরবর্তী বিভিন্ন বাণিজ্য বন্দরগুলােকে তিনি নৌবহরের নিরাপদ আশ্রয় স্থলে পরিণত করেন ।  


( ২ ) রাজরাজের সামরিক অভিযান : রাজরাজ তার সামরিক অভিযানের সূচনায় পাণ্ড্য কেরল এবং সিংহলের মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন । রাজরাজের শিলা লেখ থেকে জানা যায় যে , তিনি দুটি অভিযানে পাণ্ড্যদের ধ্বংস এবং কেরলের উদ্ধত রাজাদের পরাজিত করেছিলেন । এরপরই তিনি নৌবাহিনীর সাহায্যে সিংহল আক্রমণ করেন । সম্ভবত সিংহলের রাজা পঞ্চম মহেন্দ্র নৌবাহিনীর দ্বারা পাণ্ড্য ও কেরলকে সাহায্য করেন বলেই রাজরাজ চোল সিংহলের রাজার বিরুদ্ধে এইরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন । এই আক্রমণের ফলে সিংহলের উত্তরাংশ চোলদের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং সিংহল রাজ তার রাজ্যের দক্ষিণ - পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন । 



 রাজরাজ চোলের আমলে চোল নৌবাহিনীর আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল অসংখ্য দ্বীপসহ মালদ্বীপ বিজয় । কিন্তু এই নৌ - অভিযানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না । সম্ভবত আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে আরব বণিকদের প্রাধান্য খর্ব করার জন্যই রাজরাজ চোল মালদ্বীপ জয় করার ব্যবস্থা করেন । তবে একথা ঠিক যে দক্ষিণ ভারতে চোল নৌবাহিনীর শক্তি নিরঙ্কুশ করে তােলার জন্য রাজত্বের প্রথম দিকেই রাজরাজ চোল , চের ( কেরল ) ও পাণ্ড্যদের নৌবাহিনী ধ্বংস করেছিলেন । তখন থেকেই তিনি চোল নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করেন এবং নৌবাহিনীর সাহায্যে দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার ব্যবসা - বাণিজ্য ও রাজনীতির ওপর আধিপত্য স্থাপন করার চেষ্টা করেন । সম্ভবত এজন্য শ্রীবিজয়ের শৈলেন্দ্র রাজবংশের সঙ্গে চোলদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । তবে ভারত মহাসাগরে চোল নৌবাহিনীর একাধিপত্য স্থাপনের কৃতিত্ব রাজরাজ চোলের উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র চোলের প্রাপ্য । 
 


( ৩ ) রাজেন্দ্র চোলের কৃতিত্ব : রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালে ( ১০১৪ - ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ ) চোলরাজবংশের সামুদ্রিক কার্যকলাপ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে । এই সময় ভারত মহাসাগরে আরব বণিকদের প্রভাব খুব বৃদ্ধি পায় । আরব বণিকগণ ভারতের পশ্চিম উপকূলে বাণিজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সমর্থ হয় এবং কেরলের রাজাদের সমর্থন লাভ করে । চোলরাজারা দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে আরবদের প্রতিযােগিতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং মালাবার উপকূলের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এই প্রতিযােগিতার মূলে আঘাত করতে চেয়ে ছিলেন । আরবদের বাণিজ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পিতা রাজরাজের মতাে রাজেন্দ্র চোলও পাণ্ড্য ও কেরলের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন । সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রতীরের আরবদের নৌঘাঁটি ধ্বংস করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য । তাছাড়া ঐ অঞ্চলের ওপর চোলদের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি তার এক পুত্রকে মাদুরার শাসক নিযুক্ত করেন । রাজেন্দ্র চোলের এই কার্যের ফলে ভারত মহাসাগরে চোলদের কর্তৃত্ব আরও বিস্তৃত হয় । 


পাণ্ড্য ও কেরল রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর রাজেন্দ্র চোল শ্রীবিজয়ের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ নৌঅভিযান প্রেরণ করেন । শ্রীবিজয় ছিল একটি সামুদ্রিক রাষ্ট্র । মালব উপদ্বীপ , সুমাত্রা , যবদ্বীপ এবং অন্যান্য সংলগ্ন দ্বীপগুলাে এর অধীনে ছিল । এই রাজ্যটি ভারত ও চীনের মধ্যেকার সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করত । রাজরাজের রাজত্বকালে চোলদের সম্পর্ক বজায় ছিল । দক্ষিণ ভারতের চোল সাম্রাজ্যের সঙ্গে চীনের এবং দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপগুলাের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । শ্রীবিজয়ের শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা কর্তৃক নেগাপত্তমের বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের ঘটনাও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে । বাণিজ্য সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ ভারতের তদানীন্তন ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী চোলরাজ্যের সঙ্গে শ্রীবিজয় রাজ্যের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ।কিন্তু পরবর্তীকালে সম্ভবত শ্রীবিজয়ের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীন ও আরবের চোলদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং শ্রীবিজয়ের ওপর নিজের প্রভাব আরও দৃঢ় করে তােলার জন্য দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ায় এক বিরাট নৌবহর পাঠানাে হয় । 



তবে রাজেন্দ্র চোলের সঙ্গে শ্রীবিজয়ের বিরােধের কারণ কি ছিল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না । সম্ভবত দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার চোলদের বাণিজ্যের ব্যাপারে শ্রীবিজয় বাধার সৃষ্টি করেছিল । অথবা রাজেন্দ্র চোল একটি সামুদ্রিক সাহায্য গড়ে তােলার স্বপ্ন দেখেছিলেন । চোলদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য যাই হােক না কেন তাদের অভিযান সম্পূর্ণ জয়যুক্ত হয় । তামিল শিলালিপিতে এই অভিযানের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় । সেখানে বলা হয়েছে , উত্তাল সমুদ্রবক্ষে প্রচুর সংখ্যক নৌজাহাজ প্রেরণ করে রাজা সংগ্রাম বিজয়ােতুঙ্গ বর্মনকে বন্দী করে তার রাজধানী কাড়ারম অধিকার করা হয় । বিশাল হস্তিবাহিনীসহ রাজকোষের প্রচুর ধনরত্ন বিজয়ী সৈন্যদের হস্তগত হয় । তবে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা চোলরাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করলে বিজিত রাজাকে পুনরায় সিংহাসনে স্থাপন করা হয় । রাজেন্দ্র শ্রীবিজয়কে তার সাম্রাজ্যের একটি অংশে পরিণত করেননি । সুতরাং এই যুদ্ধজয়ের কোন স্থায়ী ফল হয়নি বলেই অনুমান করা হয় । তবে তাঞ্জোর পট্টে কম্বুজ রাজ্যের সঙ্গে রাজেন্দ্র চোলের যােগাযােগের কথা জানা যায় । কম্বুজ ছিল ইন্দোচীনের প্রাচীন নাম । সমুদ্রের তীরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির সঙ্গে রাজেন্দ্র চোলের যােগাযােগের চিহ্ন হিসাবে এই তথ্যটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ । 

রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালের শেষ দিকে সিংহলে আবার রাজনৈতিক অশান্তি দেখা দিলে নৌবাহিনীর সাহায্যে এই সময়ও তিনি শান্তি স্থাপন করতে সমর্থ হন । তবে রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যুর পর ( ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ ) তার উত্তরাধিকারীগণ আর কোন বিরাট সামুদ্রিক অভিযান কোথাও পাঠাননি । কিন্তু তখনও যে চোলরাজাদের নৌবাহিনী খুব শক্তিশালী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন