চোল রাজাদের ইতিহাস সংক্ষেপে আলােচনা কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর চোল রাজাদের ইতিহাস সংক্ষেপে আলােচনা কর chol rajader itihas songkhepe alochona koro questions answers


উত্তর : প্রাচীন যুগে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে চোলরাজাদের শাসনকাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রূপে পরিচিত । কারণ একদিকে চোলরাজবংশের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য সাধিত হয়েছিল , অপরদিকে চোলরাজগণ এক সুদক্ষ ও উন্নত শাসনব্যবস্থা  প্রনয়ন করে এবং শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে সহায়তা করে দক্ষিণ ভারতের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনে প্রয়াসী হয়েছিলেন । 

( ২ ) চোলজাতি : চোলগণ ছিল সুদূর দক্ষিণ ভারতের একটি প্রাচীন জাতি । দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূলের নেল্লোর থেকে পদুকোট্টাই পর্যন্ত তাদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল । প্রাচীন তামিল সাহিত্যে , মেগাস্থিনিসের বিবরণী এবং অশােকের শিলালিপিতে স্বাধীন চোলরাজ্যের উল্লেখ আছে । টলেমি এবং পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সী - র লেখকও চোলজাতির কথা উল্লেখ করেন । কিন্তু এইসব রচনা থেকে চোলজাতির প্রাচীন রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না । প্রচলিত মত অনুযায়ী কারিকল বর্তমান মাদ্রাজ অঞল , তার পাশ্ববর্তী কয়েকটি জেলা এবং মহীশূরের কিছু অংশ নিয়ে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে চোলরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি চের ( কেরল ) ও পাণ্ড্যদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং সিংহল ( শ্রীলঙ্কা) জয় করেন । চোলদের পুরাতন রাজধানী উরাইয়ুর এর পরিবর্তে কাবেরী পদিনম ( কাবেরীপত্তনম ) নগরীতে তিনি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । কারিকলের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নেদুমুদিকিন্নি সিংহাসন লাভ করেন । কিন্তু ইতিমধ্যে দক্ষিণ ভারতে পল্লব , চের, পাণ্ড্য প্রভৃতি রাজ্যের উত্থানের ফলে চোলরাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে । চীনা পরিব্রাজক হিউ এন - সাঙ এর চোলরাজ্যের যে সামান্য বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে ধারণা করা যায় যে সে সময় তাদের কোন গুরুত্ব ছিল না । 

( ৩ ) চোলরাজ্যের পুনরুত্থান : খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে চালুক্যরাজগণের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে পল্লবরাজবংশের পতন শুরু হলে চোলরাজবংশের রাজা বিজয়ালয়ের নেতৃত্বে চোলগণ পুণরায় প্রাধান্যলাভ করেন । পল্লব ও পাণ্ড্যদের বিরােধের সুযােগ নিয়ে তিনি তাঞ্জোর জয় করে সেখানে চোলদের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । তাঁর পুত্র আদিত্য চোল পল্লবদের প্রাধান্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে চোলরাজ্যকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করেন ও তার মর্যাদা পূন:প্রতিষ্ঠা করেন । পল্লবরাজ অপরাজিতকে যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি চোলরাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করতেও সমর্থ হন । আদিত্য চোলের পুত্র প্রথম পরান্তক ( ৯০৭ - ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ ) বীর ও সাহসী রাজা ছিলেন । প্রথম পরান্তকের আমল থেকেই চোলবংশের ধারাবাহিক ইতিহাসের সূচনা হয় । তিনি পাণ্ড্যরাজকে পরাজিত করে মাদুরা অধিকার করেন । সিংহল রাজ্যটিও তিনি জয় করার চেষ্টা করেন । কিন্তু রাষ্ট্রকূটদের নিকট পরাজিত হলে চোলদের ক্ষমতা সাময়িকভাবে আবার দুর্বল হয়ে পড়ে । 


( ৪ ) প্রথম রাজরাজ : চোলরাজবংশের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম 




রাজরাজ চোল সিংহাসনে আরােহণ করেন । তিনি ছিলেন চোলবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি । তিনি চোলদের লুপ্ত ক্ষমতা পুণরুদ্ধার করে তাদের দক্ষিণ ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করে ছিলেন । অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী প্রথম রাজরাজ দক্ষিণ ভারতের চের ( কেরল ) ও পাণ্ড্য রাজাদের পরাজিত করে চোলরাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করেন  । মহীশূরের কিছু অংশও তিনি জয় করেন । বেঙ্গীর চালুক্যরাজও তার কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন । দক্ষিণে মালাবার অঞ্চল থেকে উত্তরে কলিঙ্গা পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তৃত হয় । প্রথম রাজরাজের লেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি পশ্চিম চালুক্যরাজ সত্যাশ্রয়কে পরাজিত  করেছিলেন এবং লুণ্ঠিত সামগ্রী দিয়ে তাঞ্জোবের মন্দিরের শ্রীবৃদ্ধি করেন । প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি সিংহল আক্রমণ করেন এবং তার একাংশের ওপর নিজের কৃর্তত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । সিংহলের এই বিজিত অংশকে তিনি চোলসাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন । প্রথম রাজরাজের শক্তিশালী নৌবাহিনীর সাহায্যে তিনি পশ্চিম সাগরের মালদ্বীপ ও লাক্ষা দ্বীপের ওপর প্রভূত্ব স্থাপন করেন । গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মালদ্বীপ থেকে আরব বণিকদের উৎখাত করার জন্যই তিনি মালদ্বীপ জয় করেন । তাছাড়া তিনি পূর্ব ও পশ্চিম দিকের সাগরে অবস্থিত বহু দ্বীপ জয় করেন । ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রাজরাজের মৃত্যু হয় ।তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে পরপর বহু রাজ্য জয় করে তিনি দক্ষিণাত্যে একমাত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন । 

কিন্তু প্রথম রাজরাজ কেবলমাত্র দিগ্বিজয়ী হিসাবেই পারদর্শিতা দেখান নি, বিজিত অঞলগুলাে নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করেন । তিনি সামরিক ও বেসামরিক শাসন বিভাগেও সংস্কার সাধন করেন এবং শিল্প, স্থাপত্য , ধর্ম ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নবযুগের সূচনা করেন । তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে চোলশক্তির গৌরব প্রধানত নৌশক্তির ওপর নির্ভরশীল । একই ব্যক্তির মধ্যে বহুগুণের সমাবেশের জন্য তার ‘মহামতি’  আখ্যা সার্থক হয়েছে । 


( ৫ ) রাজেন্দ্ৰ চোলদেব : প্রথম রাজরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোলদেব ( ১০১৪ - ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ ) সিংহাসনে আরােহণ করেন । তিনিই ছিলেন চোলবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি । পিতার রাজ্য জয়ের নীতি অনুসরণ করে তিনি সমগ্র সিংহল দ্বীপ অধিকার করেন । পাণ্ড্য এবং কেরল রাজ্য ও নিজ অধিকারে আনয়ন করে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারতের ওপর নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । তারপর উত্তর ভারতেও তিনি তার ক্ষমতা বিস্তার করার জন্য সচেষ্ট হন । বেঙ্গী রাজ্যটি জয় করে রাজেন্দ্ৰ চোলদেবের বিজয়বাহিনী কলিঙ্গের গঙ্গবংশীয় রাজাকে পরাজিত করে । বাংলার পালবংশীয় রাজা প্রথম মহীপালকে পরাজিত করে রাজেন্দ্র চোলদেব গঙ্গার তীরে উপস্থিত হন । তার এই অভিযানের ফলে মধ্যপ্রদেশ , ওড়িষা এবং পশ্চিমবঙ্গের একাংশ তার অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় । বাংলাদেশ বিজয় স্মরণীয় করে রাখার জন্য রাজেন্দ্র চোলদেব ‘গঙ্গইকোণ্ড’ উপাধি গ্রহণ করেন । স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ‘গঙ্গইকোন্ড চোলপুরম’ নামে একটি নতুন নগরীর পত্তন করেন । নতুন নগরীতে তিনি তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং নগরীটি তিনি সুন্দর সুন্দর অট্টালিকার দ্বারা সুসজ্জিত  করেন । নগরীটি কেন্দ্র স্থলে চোলগঙ্গ একটি বিরাট কৃত্রিম হ্রদও খনন করা হয় ।



 রাজেন্দ্ৰ চোলদেব তার ক্ষমতা ভারত ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সন্তষ্ট হতে পারেনি । তিনি এক বিশাল নৌবাহিনী প্রেরণ করে মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত শৈলেন্দ্ররাজ্য আক্রমণ করেন । সম্ভবত ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্য সুরক্ষিত করার জন্য রাজেন্দ্র চোল শৈলেন্দ্ররাজ্য আক্রমণ করেন । রাজা রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালে চোলদের ক্ষমতা চরম শিখরে পৌছায় । চোলরাজ্যের বিজয় পতাকা গঙ্গার তীর থেকে সিংহল এবং সেখান থেকে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে জাভা , সুমাত্রা এবং মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত উড্ডীনমান থাকে । চীন সম্রাটের সঙ্গেও তিনি দূত বিনিময় করেন । 

( ৬ ) অন্যান্য চোলরাজগণ : প্রথম রাজেন্দ্র চোলদেবের পর তাঁর পুত্র প্রথম রাজাধিরাজ ( ১০৫২ -১০৬৪ খ্রিস্টাব্দ ) সিংহাসনে আরােহণ করেন । পিতার ন্যায় তিনিও কৃতী শাসক ছিলেন । বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য তাঁর সর্বদাই যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হত । ১০৫২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম চালুক্যরাজ সােমেশ্বরের কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন । প্রথম রাজেন্দ্রের পরে যথাক্রমে দ্বিতীয় রাজেন্দ্র , বীর রাজেন্দ্র , অধিরাজেন্দ্ৰ চোল সিংহাসনে আরােহণ করেন । এঁদের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা ছিল চোল এবং চালুক্যদের মধ্যে অবিরত সংগ্রাম । শেষ পর্যন্ত একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রথম কুলােতুঙ্গ চোল সিংহাসন অধিকার করেন ( ১০৭০ -১১২০ খ্রিস্টাব্দ ) চোলবংশীয়া মাতা ও পূর্ব চালুক্যবংশীয় পিতার সন্তান কুলােতুঙ্গ চোল ও পূর্ব চালুক্যরাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেন । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরের ধীরে ধীরে চোলসাম্রাজ্য অবলুপ্তির পথে অগ্রসর হয় । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন