হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর horshbordhoner rajnoitik krititok bishleshon koro questions answers


উত্তর : (১ ) ভূমিকা : প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মহারাজাধিরত হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য । গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর বহুধাবিভক্ত ভারতবর্ষে পুনরায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন হর্ষবর্ধনের প্রধান কীর্তি । কিন্তু এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা অনন্য সাধারণ অধিকারী হর্ষবর্ধনের জীবনের একটি সামান্য কৃতিত্ব মাত্র । সাহিত্যিক , সুশাসক , ধর্মানুরাগী হর্ষবর্ধন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্যই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক অতুলনীয় স্থান অধিকার করে আছেন । হর্ষবর্ধনের এই বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা যে সব ঐতিহাসিক উপাদান থেকে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে প্রধান হল ( ক ) হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্ট রচিত হর্ষচরিত , ( খ ) চীনা পরিব্রাজক হিউ এন -সাঙ - এর বিবরণ , ( গ ) জৈনকবি রবিকীর্তি রচিত আইহােল লেখ এবং ( ঘ ) সমসাময়িক অন্যান্য লেখ । তবে হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব বিচারের সময় বানভট্ট ও হিউ - এন -সাঙ এর বিবরণ খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করার প্রয়ােজনীয়তার কথা সকলেই স্বীকার করেন । তবে একথা ঠিক যে হর্ষবর্ধন যুদ্ধ ও শান্তি উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন । তাঁর কার্যকলাপকে সাধারণত চারটি বিভাগে ভাগ করা হয় — ( ক ) রাজ্য বিস্তার, (খ ) শাসন ব্যবস্থা, ( গ ) উদার ধর্মনীতি এবং (ঘ ) সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক । 


( ২ ) রাজ্য বিস্তার : উত্তর ভারতের ইতিহাসের সঙ্কটময় মুহর্তে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরােহন করেন । পুষ্যভূতি বংশের প্রভাকরবর্ধন দিল্লীর নিকট থানেশ্বরে একটি ক্ষুদ্ররাজ্য স্থাপন করেছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন সম্ভবত ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে পৈতৃক সিংহাসনে আরােহণ করেন । এই সময় মালবদেশের রাজা দেবগুপ্ত এবং গৌড়রাজ শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রীর স্বামী কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্যশ্রীকে কারাগারে বন্দী করলে রাজ্যবর্ধন তার প্রতিশােধ গ্রহণ করতে অগ্রসর হন । দেবগুপ্তকে যুদ্ধে পরজিত ও নিহত করে রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তের মিত্র গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে তাঁর হাতে পরাজিত ও নিহত হন । বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’ - এর বিবরণ অনুযায়ী গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু ঘটেছিল । এই ভাবে থানেশ্বরের সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়লে রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সিংহাসন লাভ করেন । ইতিপূবেই কনৌজরাজ গ্রহবর্মার অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু হওয়ায় কনৌজের সিংহাসনও শূন্য হয়ে পড়ে । হিউ -এন -সাঙ এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে কনৌজের অমাত্য ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিগণের অনুরােধে থানেশ্বরের অধিপতি হর্ষবর্ধন ঐরাজ্যের সিংহাসনের আরােহণ করেন । থানেশ্বর ও কনৌজের এইরুপ রাজনৈতিক সংযুক্তি সপ্তম শতাব্দীর উত্তর ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । 
বানভট্টের হর্ষচরিত থেকে জানা যায় যে সিংহাসনে আরােহণের পর হর্ষবর্ধন রাজ্য বিস্তারে মনােনিবেশ করেন এবং একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করেন । প্রথমে তিনি তাঁর ভাগনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে তাঁর ভ্রাতৃহন্তা গৌড়াধিপতি শশাঙ্ককে সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন । ইতিমধ্যে তিনি কামরুপরাজ ভাস্করবর্মনের সঙ্গেও মিত্রতা স্থাপন করেন । পূর্ব দিক থেকে ভাস্কবৰ্মন এবং পশ্চিম দিক থেকে হর্ষবর্ধন গৌড়বঙ্গ আক্রমণ করলেও গৌড়রাজ শশাঙ্ককে পরাজিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি । বিভিন্ন তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে ৬৩৭ – ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়বঙ্গে শশাঙ্ক অপ্রতিহত ভাবে রাজত্ব করেন । শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে ভাস্করবর্মন উত্তর - পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অধিকার করেন আর হর্ষবর্ধন পশ্চিমবঙ্গ ও মগধ অধিকার করেন । হর্ষবর্ধন এই সময় ‘মগধরাজ’ উপাধি ও গ্রহণ করেন । হিউ -এন - সাঙ এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে হর্ষবর্ধন একটানা ছয় বছর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন । শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযানের পর তিনি সৌরাষ্ট্রের বলভি রাজ্যে রাজা ধ্রুবসেনকে পরাজিত করেন । কিন্তু সম্ভবত ধ্রুবসেন অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং পরে হর্ষবর্ধন নিজেই তাঁর সঙ্গে নিজকন্যার বিবাহ দিয়ে ছিলেন । দক্ষিণ ভারতের চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা । হিউ - এন -সাঙ এর বিবরণ ছাড়াও দ্বিতীয় পুলকেশী কর্তৃক উৎকীর্ণ ‘আইহােল ’ শিলালিপিতে এই সংঘর্ষের বিবরণ পাওয়া যায় । কিন্তু হর্ষবর্ধন দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট শােচনীয় ভাবে পরাজিত হন এবং এই পরাজয়ের ফলে তাঁর দক্ষিণ ভারত বিজয়ের সঙ্কল্প ত্যাগ করতে হয় । বানভট্টের হর্ষচরিতে উল্লেখ আছে যে হর্ষবর্ধন সিন্ধু দেশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে জয়লাভ করেন । কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তাঁর এই সাফল্য ছিল সম্ভবত সাময়িক । সমসাময়িক গ্রন্থাদিতে উল্লেখ আছে যে তিনি ‘তুষার শৈল দেশ’ এবং কাশ্মীর আক্রমণ করেছিলেন । কিন্তু এই দুটি অভিযান সম্পর্কে বিশদ কোন তথ্য পাওয়া যায়নি । 



( ৩ ) হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তার : অপর দিকে হর্ষবর্ধনের রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় । কোথাও কোথাও তাঁকে উত্তর পথের সর্বাধিনায়ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে । কে.এম.পানিক্কর এবং রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়ের মতে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর দিকস্থ সমস্ত অঞ্চল বিস্তৃত ছিল । কিন্তু এই সময় কাশ্মীর পশ্চিম পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট , রাজপুতানা , নেপাল , কামরুপ প্রভৃতি রাজ্য স্বাধীন ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । আবার অনেকে হর্ষবর্ধনকে উত্তর ভারতের সর্বশেষ সম্রাট বা ‘সকলােত্তর পথনাথ’ বলে অভিহিত করেন । ডক্টর রমেশ চন্দ্রমজুমদার এই মতটিও ভ্রান্ত বলে মনে করেন । তাঁর মতে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য পূর্বপাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ , মগধ , ওড়িষা ও কঙ্গোদ নিয়ে গঠিত ছিল । ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার মনে করেন হর্ষবর্ধনকে উত্তর ভারতের শেষ পরাক্রমশালী সম্রাটও বলা যায় না । তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিহার নৃপতিগণ উত্তর ভারতের ঐক্য অব্যাহত রাখেন । 



( 8 ) হর্ষবর্ধনের শাসন : হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে কাঠামােগত বিশেষ পার্থক্য না থাকলেও উভয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে চরিত্রগত মৌলিক পার্থক্য দেখা যায় । এই যুগের শাসন ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক ও বিকেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে ছিল । রাজকর্মচারী ও পুরােহিত সম্প্রদায়কে বেশিমাত্রায় ভূমিদান করার ফলে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে ছিল । হর্ষবর্ধনের সময় নিয়মিত সৈন্য বাহিনী না থাকায় তাঁকে সামন্ত রাজাদের সামরিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হত । 



হিউ - এন -সাঙ হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থার খুব প্রশংসা করেন । সম্রাট স্বয়ং শাসনকার্যের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন । সে যুগের দন্ডবিধি কঠোর হলেও রাস্তাঘাটে দস্যু- তস্করের উপদ্রব ছিল । চীনা পরিব্রাজক নিজেও কয়েক বার দস্যুর হাতে লাঞ্ছিত হয়ে ছিলেন । 

হর্ষের শাসনকালে একটি সুগঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ বা মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায় । রাজ্যের কর্মচারিগণ মহাসামন্ত , মহারাজ , রাজস্থানীয় , কুমারামাত্য , বিষয়পতি প্রভৃতি নামে অভিহিত হতেন । শাসন কার্যের সুবিধার জন্য হর্ষবর্ধন তাঁর সাম্রাজ্যকে প্রদেশ , বিভাগ এবং জেলায় বিভক্ত করে ছিলেন । প্রতিটি প্রদেশকে কতকগুলাে ভুক্তি এবং প্রত্যেকটি ভুক্তিকে কতকগুলাে বিষয়ে বিভক্ত করা হয়ে ছিল । রাজ্যে তিন প্রকার কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল । ভূমি রাজস্বকে বলা হত ‘ভাগ’ । ‘ভাগ ’ উৎপন্ন শস্যের দ্বারা দেওয়া হত । ব্যবসায়ী ও কৃষকরা অর্থ দ্বারা যে কর দিত তাকে বলা হত বিরন্য । অন্য একটি কর বলি নামে অভিহিত হত । প্রয়ােজন অনুসারে কৃষকদের বীজ ও কৃষি কার্যের সাজ - সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করা হত । 



( ৫ ) উদার ধর্মনীতি : হর্ষবর্ধন প্রথম জীবনে সম্ভবত শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন । কিন্তু রাজত্বের শেষের দিকে তিনি মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন । তবে অন্যান্য ধর্মর প্রতি তেমন কেবলমাত্র সহিষ্ণুই ছিলেন না । শ্রদ্ধাশীলও ছিলেন । হর্ষবর্ধন, বৌদ্ধপন্ডিতদের সভা আহ্বান করে ধর্ম সম্বন্ধে তাঁদের বিতর্ক শুনতেন এবং তাঁদের পুরস্কৃত করতেন । 


সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজ্যে হিউ এন -সাঙ আট বছর ( ৬৩৫ – ৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দ ) ছিলেন । হিউ এন -সাঙ এর সম্মানে হর্ষবর্ধন কনৌজে এক বিশাল সমাবেশের আয়ােজন করেন । বহু রাজা সামন্ত ও অভিজাত ব্যাক্তি ঐ সমাবেশে যােগ দেন । শিবের উপাসক হর্ষ সেই সভায় প্রকাশ্য ভগবান বুদ্ধের আরাধনা করেন এবং হিউ এন -সাঙ সেই সভায় বৌদ্ধধর্মের মহাযান মত বিশ্লেষণ কর । 



সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রয়াগে যে প্রতি পাঁচ বছর পর দানােৎসের প্রবর্তন করেন তার ষষ্ঠ উৎসবের সময় হিউ এন -সাঙ উপস্থিত ছিলেন । তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায় যে সেই উৎসবে ভগবান বুদ্ধ ছিলেন প্রধান উপাস্য দেবতা । তবে সূর্য, শিব প্রমুখ দেবতারও পূজা হত । বৌদ্ধ , ব্রাত্মণ,জৈন প্রভৃতি সকল ধর্মাবলম্বী সাধুসন্তরাই সেখানে দান গ্রহণ করতেন । সাধু , সন্ন্যাসী  ও গরীব - দুঃখীদিগকে তিনি পাঁচ বছরের সঞ্জিত সমস্ত ধন - সম্পত্তি দান করে দিতেন । 



( ৬ ) সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক : ৪১ বছর রাজত্ব করে হর্ষবর্ধন ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান । তিনি অদম্য উৎসাহের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন । শাসনকার্যের দায়িত্ব সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন এবং ‘নাগানন্দ’ ‘প্রিয়দর্শিকা’ ও ‘রত্নাবলী’ নামে তিনখানি নাটক তিনি রচনা করেন । ‘হর্ষচরিত’ ও ‘কাদম্বরী ’ রচয়িতা বানভট্ট ছিলেন তার সভাসদ ছিলেন । তাছাড় ময়ূর, ভর্তৃহরি , দিবাকর , জয়সেন প্রমুখ বিদ্বান তার রাজ সভা অলঙ্কৃত করতেন ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন