মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি ব্যাখ্যা করাে ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি ব্যাখ্যা করাে mughol samrajyar potoner karonguli bakkha koro


উত্তর : মধ্যযুগে মােঘল সাম্রাজ্য আয়তন , জনসংখ্যা ও আর্থিক সম্পদে সমগ্র বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করেছিল । এতবড় একটি সাম্রাজ্যের পতন কেবলমাত্র একটি কারণে সম্ভব হয়নি । দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি অভ্যন্তরীন কারণে এর ভিত্তি শিথিল হয়েছিল , অবশেষে বহির্দেশ থেকে কয়েকটি আক্রমণ এর ওপর চরম আঘাত হানে ।


মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি হল - 


সামরিক দুর্বলতা : মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মােঘল সাম্রাজ্যও মূলত সামরিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । মােঘলগণ ছিলেন নিতান্তই সামরিক জাতি । ভারতবর্ষে যতদিন যুদ্ধের প্রয়ােজন ছিল ততদিন তাদের গুণাবলী ও শক্তি ছিল অটুট , কিন্তু যখন তার প্রয়ােজন মিটে যায় , তখন থেকে নানাদিক দিয়ে তাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল । 

সম্রাটের ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর নির্ভরশীল : মােঘল শাসন ছিল স্বৈরাচারী , একনায়কতন্ত্র , এক্ষেত্রে সম্রাটের ব্যক্তিগত চরিত্র, বুদ্ধি, কর্মনিষ্ঠা ও সামরিক শক্তির উপরই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব একান্তভাবে নির্ভর করতাে । ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত মােঘল সম্রাটগণের পরিশ্রম ও কর্মনিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যের ঐক্য ও শৃঙ্খলা মােটের উপর অব্যাহত ছিল কিন্তু পরবর্তীযুগের বিলাসপ্রিয় দুর্বল সম্রাটগণ সাম্রাজ্যকে সংকট থেকে রক্ষা করার মতাে কোনাে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল । 
 

জনগণের সমর্থনের অভাব : স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের অপর সমস্ত ত্রুটিও মােঘল সাম্রাজ্যে স্বভাবতই বিদ্যমান ছিল । জনসাধারণের স্থায়ী সমর্থন ও আনুগত্যের ওপর মােঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল না ।  


অর্থনৈতিক সংকট : সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামাে শক্তিশালী করবার কোনাে প্রচেষ্টা ছিল না । একদিকে যেমন ছিল রাজকীয় আড়ম্বর ও বিলাস -ব্যসন ,অন্যদিকে , তেমন ছিল প্রজাসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্গতি । একটি স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক নীতি দ্বারা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক শক্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করার কোনাে চেষ্টাই ছিল না । একদিকে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি, অন্যদিকে , শিল্প- বাণিজ্যের প্রসারের দিকেও মােঘল শাসকগণ প্রয়াসী হননি । 


কৃষিসংকট :  এদিকে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ অত্যাধিক হওয়ায় কৃষকগণের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায় ও কৃষিক্ষেত্রে সংকট দেখা যায় । ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে , মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল কৃষি সংকট । কৃষককূলের অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে এবং জাঠ ,সনামী , শিখ বিদ্রোহে কৃষকগণ দলে দলে সামিল হন । 


রাস্তাঘাট ও যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাব : সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন , মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল । মধ্যযুগে রাস্তাঘাট বা যােগাযােগের ব্যবস্থা সুবিধাজনক ছিল না । সুতরাং দূরবর্তী প্রদেশসমূহের ওপর কেন্দ্র থেকে দৃষ্টি রাখা এক দূরহ ব্যাপার ছিল । 

 
উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব : উত্তরাধিকার সম্বন্ধে কোনাে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় প্রতিবারই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়েছিল । এর ফলে ,স্বার্থান্বেষী আমীরগণের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়েছিল । 


অভিজাত শ্রেণির অবক্ষয় :  মােঘল শাসনের শেষদিকে অভিজাত শ্রেণির মধ্যেও নানা দুর্বলতা প্রবেশ করেছিল । বিলাস -প্রিয়তা, স্বার্থান্বেষণ, আত্মকলহ প্রভৃতি তাদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল । অথচ এই অভিজাত শ্রেণিই এক সময়ে সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ ছিল । ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে মােঘল অভিজাতশ্রেণির দলগত ও গােষ্ঠীগত বিরােধ সৃষ্টি হয় । সতীশচন্দ্র প্রমুখ ঐতিহাসিকগণের মতে , তাদের নৈতিক অধঃপতনের ফলে মােঘল সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে বেশী ক্ষতিকারক হয়েছিল । 


নৌ বাহিনীর অভাব : নৌ বাহিনীর অভাবকে মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলে ঐতিহাসিক স্মিথ উল্লেখ করেছেন । তার মতে , এই দুর্বলতার জন্যই মােঘলগণ নৌ -বলে বলীয়মান ইউরােপীয়গণকে পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । কিন্তু এই মত গ্রহণযােগ্য নয় , কারণ ইউরােপীয় অপেক্ষা মারাঠাগণের নিকট থেকে মােঘল সাম্রাজ্যের উপর প্রথম ও প্রধান আঘাত এসেছিল ।



ঔরঙ্গজেবের পরধর্ম অসহিষ্ণুতা : মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেব ধর্মান্ধতা ও দাক্ষিণাত্য নীতি যথেষ্ট দায়ী ছিল । তার পরধর্ম অসহিষ্ণুতার জন্য হিন্দু প্রজাগণ সাম্রাজ্যের পরম শত্রুতে পরিণত হয়েছিল । তাঁরই অদূরদর্শিতার ফলে জাঠ ,রাজপুত , মারাঠা ও শিখদের তরফ থেকে মােঘল সাম্রাজ্যবিরােধী আন্দোলনের অভ্যুদয় ঘটেছিল এবং ফলে সাম্রাজ্যের বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল । 


বহিঃ আক্রমণ : কেবলমাত্র এই সমস্ত আভ্যন্তরীন কারণে হয়তাে মােঘল সাম্রাজ্য এত দ্রুত ভেঙে পড়তাে না । যদি না বহিঃ আক্রমণ না ঘটতাে । প্রথমে নাদির শাহ এবং পরে আহম্মদ শাহ দুরবানী বারবার সাম্রাজ্যের উপর আঘাত হেনেছিল । এই আঘাত থেকে সাম্রাজ্যকে বাঁচানাের কোনাে ক্ষমতা দুর্বল সম্রাটদের ছিল না । 

 
উপসংহার : এইরূপভাবে আভ্যন্তরীন ও বহিরাগত কারণে একদা বিশাল মােঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়েছিল । মােঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে কোনাে একটি বিশেষ কারণ বা কোনাে বিশেষ ব্যক্তি দায়ী ছিলেন তা বলা যায় না । যদিও ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি মােঘল সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল , তথাপি শাহজাহানের রাজত্বকাল থেকে সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখা যায় । দুর্ভাগ্যবশতঃ ঔরঙ্গজেব সামাজিক , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় কাঠামােগত সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হন এবং সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন