ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি বা কেন ১৮৮৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠে ?

Clg history questions answers কলেজ প্রশ্নোত্তর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি বা কেন ১৮৮৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠে keno ১৮৮৬ khirstabde jatiyo congress gore othe


উত্তর : ১৮৮৮৫ সালে ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল । জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পটভূমি ব্যাখ্যা করা খুব সহজ কাজ নয় । কারণ পণ্ডিতদের মধ্যে উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে । পটুভি সীতারামাইয়ার মতে প্রধানত ভিন্নমুখী পরিকল্পনার ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সূত্রপাত হয় । ১৮৭৭ সালে দিল্লির দরবার , ১৮৮৩ সালে জাতীয় সম্মেলন , ১৮৮৮৪ সালে থিওজ্যফিকাল সােসাইটির অধিবেশন প্রভৃতি ভিন্নমুখী পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে ১৮৮৫ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের সূত্রপাত । সীতারামাইয়া আরও মনে করেন যে ১৮৮০ সালের পর থেকে যাতে করে বিভিন্ন চিন্তার প্রভাবও মিলিত হতে পারে এবং সর্বাহী কর্মসূচি নির্ধারণ করা সম্ভবপর হতে পারে । এরূপ একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অভাব যথেষ্ট পরিমাণে অনুভূত হয় । দেশের এই মনােভাবকে বাস্তবের রূপদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারত সরকারের অবসবপ্রাপ্ত আই.সি.এ. কর্মচারী অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম । 


ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার অক্টোভির ভিত্তি ভিন্নমুখী প্রভাব তত্ত্বকে অস্বীকার করেছে । তার মতে লর্ড লিটনের প্রতি ক্রিয়াশীল নীতি সংবাদপত্রের দমন , অস্ত্র আইন , লর্ড রিপনের আমলে ইলবার্ট বিল আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের মনােভাব প্রকাশ করে এবং তাকে দূরীভূত করার প্রয়ােজনীয়তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপলব্ধি করেন । ১৮৮৩ সালে ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন - এর ব্যবস্থাপনায় তিনি একটি সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা ন্যাশনাল কনফারেসের অধিবেশন ডাকেন । রমেশচন্দ্র মজুমদার -এর মতে ১৮৮৩ সালে জাতীয় সম্মেলনের আদর্শ থেকে দুই বছর পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা কার্যকরী করা হয় । 


জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলেও কংগ্রেসের গঠনে বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন অক্টোভিয়ান হিউম । সীতারামাইয়া বলেন যে হিউম বড়লাট লর্ড ড্যাফরিনের আনুকূল্যে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন ।
 

হিউমের জীবনী লেখক স্যার উইলয়াম ওয়েডারবান বলেছেন যে প্রায় ৩০ হাজার গােয়েন্দার রিপাের্ট পড়ে হিউমের মনে হয়েছিল যে একটা ‘দারুণ বিপ্লব’ আসন্ন । জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন রক্ষাতে একটি ‘সেফটি ভালভ’ ব্যবস্থা করা । হিউম নিঃসন্দেহে বলেছিলেন যে, শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সঞ্চারিত হয়েছে । সুতরাং এই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশের জন্য একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন । এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ব্রিটিশ সরকার তার কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে সক্ষম হবে । হিউম ভারতে রাজনৈতিক মুক্তির জন্য মােটেই চিন্তিত ছিলেন না । ভারতীয়দের অসন্তোষ প্রশমিত করার প্রয়ােজনীয়তা হিউম অনুভব করেন । মৃদু ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রশ্রয় দিয়ে হিউম প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের গণ্ডির মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন । ১৮৮৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একখানি  ‘খােলাচিঠি’ প্রকাশ করে ছাত্রদের রাজনৈতিক সামাজিক , মানবিক ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্য তিনি একটি স্থায়ী সংস্থা গঠনের উপদেশ দেন । এরূপ সংস্থার প্রতি সরকারি সমর্থনের আশ্বাসও তিনি প্রদান করেন । 


তদানীন্তন ভারতের বড়লাট শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ভারতবাসীর মতামত ও অভিপ্রায় প্রকাশের প্রয়ােজন উপলব্ধি করেন । সুতরাং হিউমের প্রস্তাব অতি সহজেই ডাফরিনের সমর্থন লাভ করে । কিন্তু এটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনে ভারতের জাতীয় নেতারা কেন ওই সময় সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তার ব্যাখ্যা সহজে মেলে না । প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন এক নতুন সামাজিক শক্তির প্রতিনিধি । ব্রিটেনের স্বার্থে ভারতকে যেভাবে শােষণ করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে সােচ্চার প্রতিবাদ । তাদের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল । তার এমন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন অনুভব করেছিলেন যাকে হাতিয়ার করে ভারতের সামাজিক , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সংগ্রাম চালানাে সম্ভবপর হবে । যদি একথা সত্য হয় যে জাতীয় কংগ্রেসকে ব্রিটিশ সরকারের সেফটি ভালভ হিসাবে ব্যবহার করা হিউমের উদ্দেশ্য ছিল তাহলে একথাও বলতে হবে যে কংগ্রেস নেতারা হিউমকে Lighting Condractor ব্যবহার করতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন । এই প্রসঙ্গে গােপালকৃষ্ণ গােখলে লিখেছেন যে কোনাে ভারতীয় পক্ষে সেই সময় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর ছিল না । 

 
রজনীকান্ত দত্ত বলেছিলেন যে জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে পক্ষপাতির ফলে সৃষ্টি হয় । এটি একটি ‘গােপন ষড়যন্ত্রের’ ফলশ্রুতি । কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সরকার একটি অসম্ভাবী বিদ্রোহ নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয় । ভারতবর্ষের বিপ্লবকে প্রতিরােধ করার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য কর্মচারী হিউম কংগ্রেসের জন্ম দেন । তিনি মনে করেন যে কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলনে এর ছাপ খুবই স্পষ্ট । এই সম্মেলনে যে ৭ টি প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কিছু রদ বদলের জন্য উমেদারী করা হয় । অন্যদিকে এস . আর . মেহেতা প্রভৃতি আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন হিউম কোনাে বড়াে মনােভাব নিয়ে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি । তিনি ভারতীয় জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পথে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হন । কংগ্রেসের প্রতি হিউমের অগাধ আস্থা ছিল এবং তিনি একে জাতীয় আন্দোলন বলে আখ্যা দিয়েছেন । 


সম্প্রতি বিপনচন্দ্র সেফটি ভালব তত্ত্বকে ‘Myth’ বলে অভিহিত করেছেন । তার মতে হিউম যে গভীর জন অসন্তোষের কথা বলেছেন বাস্তবের সাথে তার কোনাে মিল ছিল না । বিপানচন্দ্র দেখিয়েছেন হিউম ছিলেন রাজস্ব বিভাগের সচিব । সুতরাং তার পক্ষে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ফাইল দেখার কোনাে সুযােগ ছিল না । অথচ গােপন ষড়যন্ত্রের সূত্র ছিল এই ফাইল । তাছাড়া এই সমস্ত ফাইল থাকত দিল্লিতে আর হিউমের অফিস ছিল সিমলায় । সুতরাং বিপিনচন্দ্রের মতে তিনি যে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির কথা বলেছেন তা নিছক কল্পনা । বাস্তবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতাকে ১৮৬০-৭০ দশক থেকে রাজনৈতিক জনজাগরণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ফলশ্রুতি বলে উল্লেখ করেছেন । বস্তুতপক্ষে হিউম কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হলেও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুধুমাত্র হিউমের মস্তিষ্ক প্রসূত ছিল না । কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতা প্রায় ১৫ বছর পূর্ব থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে । কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউম অগ্রণী ভূমিকা নিলেও হয়তাে কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠত । উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে রাজনীতি সচেতন ভারতীয় কার্যকলাপ যৌক্তিক পরিণতির পথে অগ্রসর হয়ে কংগ্রেসের জন্ম দিয়েছিল । এতে হিউম ও ডাফরিনের অংশগ্রহণকে মােটামুটি আকস্মিক বলা যেতে পারে ।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন