আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণ দাও । এই অভিযানের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ফলাফলগুলাে কি কি ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণ দাও এই অভিযানের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ফলাফলগুলাে কি কি aleksandarer bharat abhijaner protokkho o porokkho folafolgulo ki ki questions answers


উত্তর : ( ১ ) উত্তর - পশ্চিম ভারতের অবস্থা : গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর - পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার যে চিত্র পাওয়া গিয়েছে তা সমস্তই গ্রীক লেখকদের নিকট থেকে সংগৃহীত । সমসাময়িক ভারতীয় কোন সাহিত্যে এ বিষয়ে কোন আলােচনা পাওয়া যায় না । আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা সরকারীভাবে অবশ্য পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল , কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বহুদিন পূর্বেই ঐ অঞ্চল কতগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল । এই সকল রাজ্যের মধ্যে কতগুলাে ছিল রাজতান্ত্রিক আবার কতগুলাে ছিল প্রজাতান্ত্রিক ।গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে যে সকল রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি হল— ( ক ) কাবুল নদীর উত্তর দিকে পর্বতসঙ্কুল দেশের অধিবাসী অশ্বায়ণ জাতি , ( খ ) সােয়াত অঞ্চলের অশ্বকায়ন বা অশ্বকরাজ্য , ( গ ) কাবুল ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলের নিকিয়া রাজ্য , ( ঘ ) পূর্ববর্তীকালের গান্ধার রাজ্যের পশ্চিম অংশের পুষ্কলাবতী , ( ঙ ) তক্ষশীলা রাজ্য, ( চ ) ঝিলাম ও চেনার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত পৌরব অর্থাৎ পুরুররাজ্য , ( ছ ) ঝিলাম নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের সৌভূতির রাজ্য ছাড়াও ক্ষুদ্রক , মালব , অভিসার , মুষিক , নিসা প্রভৃতি কতকগুলাে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য ।  এই সব রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক একতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না । সর্বদাই এই সকল রাজ্যগুলাের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত একনকি কোন বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখেও তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারত না । উত্তর - পশ্চিম ভারতের এইরুপ রাজনৈতিক বিভেদই আলেকজান্ডারের অভিযানের পথ রচনা করেছিল । 



( ২ ) আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ : গ্রীস দেশের উত্তরাংশে ম্যাসিডনের অধিপতি ফিলিপের পুত্র দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ৩৩৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে যে সামরিক অভিযান শুরু করেন তার শেষ পর্ব হল ভারত আক্রমণ । পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর অধিপত্য বিস্তার করার পর ৩২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তে এসে উপস্থিত হন । সাধারণভাবে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে কয়েকটি বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে আলেকজান্ডার ভারত অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । ( ক ) গ্রীক সাম্রাজ্য বিস্তার এবং সামরিক গৌরব অর্জন করাই ছিল আলেকজান্ডারের স্বপ্ন । ( খ ) সরকারীভাবে সিন্ধু উপত্যকা ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত প্রদেশের ওপরই তার স্বাভাবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে তিনি ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হন । ( গ ) জল ও স্থলপথে ভারতের সঙ্গে স্থায়ী যােগাযােগ ব্যবস্থা স্থাপন করা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করা তার এই অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল । ( ঘ ) উত্তর পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারকে স্বাভাবিক ভাবেই প্রলুব্ধ করেছিল । 

ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হয়েই আলেকজান্ডার সর্বপ্রথম পার্বত্য জাতিগুলােকে পদানত করেন । কুনার এবং সােয়াত উপত্যকায় আধিপত্য বিস্তার করে তিনি মগ , বরুণ ও নিসা অধিকার করে । 


৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধুনদ অতিক্রম করেন । উত্তর পশ্চিম ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাে এই সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদেশী আক্রমণ প্রতিরােধ করার চেষ্টা না করায় আলেকজান্ডারের পক্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা আরও সহজ হয়ে ওঠে । বিশেষত তক্ষশীলার রাজা অম্ভি বিনা যুদ্ধে আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং আক্রমণকারীকে সিন্ধুনদ অতিক্রম করতে সাহায্য করেন এবং নিজের রাজ্যে সাদরে তাকে অভ্যর্থনা জানান । এই ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেন যে ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম একজন রাজা স্বদেশের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন । তার পর কয়েকটি ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য জয় করে আলেকজান্ডার তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ঝিলাম নদীর তীরে অগ্রসর হন । ঝিলাম নদীর পূর্বপারে পৌরবরাজ পুরু স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এবং বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করেন । রাজা পুরু প্রবল বিক্রমে বাধা দিয়েও শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পরাজিত হন । গ্রীক ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে হাইদাম্পেসের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধের অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যায় । রাজা পুরু যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হলেও বীরের উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে আলেকজান্ডার তার বন্ধুত্ব লাভ করেন এবং পুরুর সাহায্যে বিশাল সৈনবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগকে নিরাপদ করে রাখার ব্যবস্থা করেন । 


রাজা পুরুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার পর আলেকজান্ডার পূর্বদিকে আরও অগ্রসর হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি পার্বত্য জাতিকে পরাজিত করেন । চন্দ্রভাগা ও ইরাবর্তী নদী অতিক্রম করে তিনি বিশাপা নদীর দিকে অগ্রসর হন । গাঙ্গেয় উপত্যকায় মগধ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও সামরিক অভিযানের ইচ্ছা তার ছিল । কিন্তু তার রণক্লান্ত সৈন্যবাহিনী আর অগ্রসর হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে । এই পরিস্থিতিতে তিনি ৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে সিদ্ধান্ত নেন । তিনি তাঁর একটি সৈন্যদলকে সেনাপতি নিয়ার্কসের অধীনে সিন্ধুনদ হয়ে পারস্য পাঠাবার ব্যবস্থা করেন । অপর সৈন্যদল দিয়ে আলেকজান্ডার স্থলপথে পারস্যের দিকে যাত্রা করেন । প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি নানা বাধার সম্মুখীন হন কিন্তু তা সত্ত্বেও শিবি , মাল্ল, ক্ষুদ্রক প্রভৃতি জাতিকে তিনি তার আধিপত্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেন । আলেকজান্ডার স্থল পথে পারস্যের উপকূল দিয়ে ব্যাবিলনে পৌঁছান এবং ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩২ বছর বয়সে সেখানে তার মৃত্যু হয় । 

( ৩ ) প্রত্যক্ষ ফলাফল : ভারতে আলেকজান্ডারের আক্রমণের প্রকৃতি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে , কেবল সামরিক কৃতিত্ব অর্জন বা দস্যুর মত লুণ্ঠন করার জন্য তিনি এদেশ আক্রমণ করেন নি, সিন্ধুদেশে অবস্থিত প্রদেশগুলাে স্থায়ীভাবে গ্রীক সাম্রাজ্যভুক্ত করাই ছিল তার প্রকৃত উদ্দেশ্য । (ক ) তিনি ভারতের বিজিত অঞ্চল সমূহকে পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একজন করে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । (খ ) সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং নদীর তীরে তিনি কয়েকটি নগরী ও গ্রীক সৈন্যশিবির স্থাপন করেন । (গ ) জল ও স্থলপথে যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করার দিকেও তিনি দৃষ্টি দেন । কিন্তু আলেকজান্ডারের অকাল মৃত্যুর ফলে তার সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা ব্যর্থ এবং তার প্রত্যাবর্তনের মাত্র দুবছরের মধ্যেই এই সমস্ত ব্যবস্থা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । এমনকি ভারতের সমসাময়িক ইতিহাস এবং সাহিত্যেও আলেকজান্ডারের আক্রমণ ও রাজ্য বিজয় কোন প্রকার গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি । সংক্ষেপে বলা যায় যে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল খুবই সামান্য । মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে এই প্রভাব অনুভূত হয় । প্রথমত ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তে কয়েকটি গ্রীক উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল । রাজনৈতিক দিক থেকে এই সব উপনিবেশ গুরুত্বহীন হলেও গ্রীক সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে এদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না । দ্বিতীয়ত ভারতবর্ষ ও পাশ্চাত্য দেশ সমূহের মধ্যে কয়েকটি স্থলপথ এবং একটি জলপথ আবিষ্কৃত হওয়ায় উভয় অঞলের মধ্যে ব্যবসা -বাণিজ্যের সুযােগ বৃদ্ধি পায় । তৃতীয়ত প্রাচ্য সম্পর্কে ভৌগােলিক ও অন্যান্য জ্ঞান পাশ্চাত্য দেশে বিস্তার লাভ করায় ভারত সম্পর্কে ইয়ােরােপীয়দের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ।  


( ৪ ) পরােক্ষ ফলাফল : আলেকজান্ডারের অভিযানের পরােক্ষ ফল ছিল সুদূরপ্রসারী । ( ক ) উত্তর- পশ্চিম ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গুলােকে বিনষ্ট করে আলেকজণ্ডার এক শাসনাধীনে আনয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই পরবর্তী কালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পক্ষে অতিসহজেই বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল । তাছাড়া ভারতের উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক কাঠামাের পরিবর্তন ঘটিয়ে ও পরে সেখাকে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার পথ প্রশস্ত করে তুলেছিলেন । এই অভিযানের ফলে ভারত ও পাশ্চাত্য দেশগুলাের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় ভবিষ্যতে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বানিজ্যিক ও কৃষ্টিগত আদান - প্রদানের পথ পরিষ্কার হয়েছিল । এর ফলে পরবর্তী যুগে ভারতীয় শিল্পের ওপর গ্রীক ও রােমান প্রভাব দেখা দেয় এবং গান্ধার শিল্পের মতাে উন্নতমানের শিল্পের উদ্ভব হয় । ভারতীয় শিল্পকলা ছাড়াও বিজ্ঞান , মুদ্রানীতি প্রভৃতি ওপর গ্রীক প্রভাব দেখা যায় । মুদ্রার ক্ষেত্রে ভারতীয়গণ গ্রীক ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিল । অনেকে মনে করেন ভারতীয় শব্দ ‘দাম’ (মূল্য) গ্রীক শব্দ দ্ৰাকমা  থেকে উদ্ভূত । তৃতীয়ত ভিনসেন্ট স্মিথের মতে মৌর্যোত্তর যুগে বৌদ্ধধর্মের মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌত্তলিকতার দিকে ঝোঁক গ্রীক পৌত্তলিকতার প্রভাবের ফল । অপরদিকে খ্রিষ্টধর্মের নস্টিক  সম্প্রদায়ের উপর ভারতীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । সুতরাং উপসংহারে বলা যায় যে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফলাফলের তুলনায় পরােক্ষ ফলাফল ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন