রাজা খারবেলের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর রাজা খারবেলের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর raja kharbeler jiboni o krititto alochona koro questions answers

উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা : সম্ভবত মধ্যদেশ থেকে চেদী গােষ্ঠীর একটি শাখা কলিঙ্গে এসে নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে । সাধারণত এই রাজবংশ চেত রাজবংশ নামে পরিচিত । বর্তমান ওড়িষ্যার পুরী , গঞ্জাম জেলা ও কটক জেলার কতক অংশ নিয়ে প্রাচীনকালের কলিঙ্গরাজ্য গঠিত ছিল । কলিঙ্গের চেদি ( চেত ) রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্ভবত মেঘবাহন নামক জনৈকরাজা । এই রাজবংশ নিজেদের আর্য বলে দাবি করত । সম্ভবত অনার্য অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করেন বলেই তারা আর্যত্বের দাবি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন উপলব্দি করেন ।



( ২ ) খারবেল এর সময় সমস্যা : ওড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের নিকট প্রাপ্ত হাতিগুম্ফা লিপি থেকে রাজা খারবেল এর রাজত্ব কালের কাহিনী সংগ্রহ করা হলেও রাজত্বের সময় সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রবল মতবিরােধিতা দেখা দেয় । ডক্টর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ খারবেলকে মহাপদ্মনন্দের তিন শতাব্দী পরে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষদিকের রাজা বলে সিদ্ধান্ত করেন । আবার অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ছিলেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পূর্ববর্তী যুগের শাসক । তাদের এই মতের পক্ষে তারা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে , খারবেলের সৈন্যদের দ্বারা মগধ আক্রান্ত ও লুষ্ঠিত হয় । শুঙ্গ শাসকদের গৌরবের যুগে তা কোন ক্রমেই সম্ভব ছিল না । সুতরাং রাজা খারবেল হয় শূঙ্গদের পূর্ববর্তী অথবা তাদের শক্তির পতনােন্মুখ সময়ের রাজা । তাদের মতে প্রথম মতটিই অধিকতর গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয় । কারণ হিসাবে তারা বলেন যে খারবেল এর রাজগৃহ অভিমুখে অগ্রগতির সংবাদ পেয়ে মগধ আক্রমণকারী যবনরাজ দ্রুত মথুরায় পলায়ন করেন । সমগ্র ইতিহাসে গ্রীক সৈন্যদল মাত্র একবারই পাটলিপুত্র পর্যন্ত অগ্রসর হয় । পতঞ্জলির মহাভাষ্যে গ্রীকদের এই আক্রমণকে অদূর অতীতের ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয় । এই আক্রমণের নেতা ছিলেন পূর্ব পাঞ্জাবের শাসনকর্তা ডেমিট্রিয়াস । ঐতিহাসিকগণ ডেমিট্রিয়াসের আক্রমণকে পুষ্যমিত্রের সিংহাসনে আরােহনের পূর্ববর্তী বলে মনে করেন । সুতরাং এই যুক্তির ওপর নির্ভর করেই তারা খারবেলকে পুষ্যমিত্রের পূর্ববর্তী বলে মনে করেন । অপরদিকে হাতিগুম্ফা লিপিতে স্বাধীন রাষ্ট্রীক ও ভােজক উপজাতিদের কথা বলা হয়েছে । এই দুটি স্বাধীন উপজাতির উল্লেখ দেখে মনে হয় খারবেল মৌর্য সম্রাট অশােকের নিকটবর্তী সময়ের রাজা ছিলেন । কারণ পরবর্তী কালে এই দুটি উপজাতির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয় । 


কিন্তু অপরদিকে একদল ঐতিহাসিক উপরি উক্ত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেন এবং খারবেলকে প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের রাজা বলে স্থির করেন । তাদের মতের সমর্থনে তারা কয়েকটি যুক্তি প্রদর্শন করেন । প্রথমত খারবেল ‘মহারাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন । মহারাজাধিরাজ উপাধির মতাে ইন্দো গ্রীক শাসকদের প্রভাবেই মহারাজ উপাধির উৎপত্তি হয় ।খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইন্দোগ্রীক রাজগণ অনুরুপ উপাধি গ্রহণ করতে শুরু করেন । উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে অনেক দূরে অবস্থিত কলিঙ্গে এইরুপ উপাধি গ্রহণের রীতি প্রচলিত হওয়া অবশ্যই সময় সাপেক্ষ ছিল । দ্বিতীয়ত খারবেল এর সমসাময়িক মগধের রাজা বৃহৎস্বাতীমিত্র শুঙ্গ বা কাঞ্চবংশের সন্তান ছিলেন না । তিনি নিঃসন্দেহে পুষ্যমিত্র শুঙ্গের অনেক পরবর্তী কালের রাজা ছিলেন । তৃতীয়ত , হাতিগুম্ফা লিপির বর্ণমালা নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষদিকের বেসনগর লিপির পরবর্তী কালের সুতরাং হাতিগুম্ফা লিপিকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর বলে মনে করা যেতে পারে ।চতুর্থত, হাতিগুম্ফা লিপি থেকে জানা যায় যে , খারবেল ‘তিবশ শত’ নন্দরাজ অর্থাৎ নন্দরাজের তিনশ বছর পরে রাজত্ব করেন । সেদিক থেকে তাঁকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে স্থাপন করা যেতে পারে । পঞ্চমত খারবেলের মগধ অভিমুখে অগ্রগতির সংবাদ পেয়ে যে যবনরাজ পশ্চাৎ অপসারণ করেন । তিনিই যে ডেমিট্রিয়াস তা নিঃসন্দেহে বলা সম্ভব নয় । ষষ্ঠত , রাজা সাতকর্ণি সম্ভবত সাতবাহন রাজবংশের প্রথম সাতকণি । এই সাতকর্ণি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাজত্ব করতেন । সুতরাং রাজা খারবেল তার সমসাময়িক অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব প্রথ মশতাব্দী দ্বিতীয়ার্ধের মানুষ ছিলেন । 




( ৩ ) রাজত্বের প্রধান প্রধান ঘটনা : প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে রাজা খারবেল একটি উল্লেখযােগ্য চরিত্র । হাতিগুম্ফা লিপিতে তাঁর জীবনের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় । জীবনের প্রথম পনেরো বছর তিনি তরুণ রাজকুমার সুলভ জীবন অতিবাহিত করেন । রাজকুমারের উপযুক্ত ক্রীড়া কৌতুক, আমােদ প্রমােদ অর্থনীতি , মুদ্ৰাবিজ্ঞান, হিসাবশাস্ত্র ,শাসন পদ্ধতি প্রচলিত আইনকানুন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন । ষোল বছর পূর্ণ হওয়ার পর তিনি কলিঙ্গরাজ্যের যুবরাজের পদে অভিযুক্ত হন । চব্বিশ বছরের সময় তিনি কলিঙ্গের মহারাজ উপাধি গ্রহন করেন এবং চক্রবর্তী অথবা বিশ্বজনীন শাসক হিসাবে নিজেকে ঘােষণা করেন । সম্ভবত তিনি  মহাবিজয় উপাধিও গ্রহণ করেন । ললাক রাজ পরিবারের রাজা হস্তিসিংহের পৌত্রের এক কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন । খারবেল জৈনধর্মের প্রতি অবিচলিত ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন । কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে তার কোন গোঁড়ামি ছিল না এবং মৌর্য সম্রাট অশােকের মতাে তিনি তার রাজ্যের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অধিবাসীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতেন । 


সিংহাসনে আরােহনের অল্প দিনের মধ্যেই খারবেল দিগ্বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । সিংহাসন আরােহনের দ্বিতীয় বর্ষে তিনি তার রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন । এই সময় কলিঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে সাতবাহন রাজবংশের সাতকর্ণির অধিকার বিস্তৃত ছিল । কিন্তু খারবেল সাতকর্ণির শক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন । এই অভিযানের সময় কলিঙ্গের সৈন্যদল কৃষ্ণবেন অর্থাৎ কৃষ্ণানদী পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং ঋষিকনগর নামক নগরীর নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করতে সমর্থ হয় । কিন্তু এই সামরিক অভিযানের সময় খারবেল এর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সাতকর্ণির সৈন্যবাহিনীর কোন সংঘর্ষ হয়েছে কিনা অথবা ঋষিক নগর সাতবাহনদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা এরুপ কোন ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবের জন্য অনুমান করা হয় যে , প্রতিবেশী দুই রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং কলিঙ্গের সৈন্য বিনা বাধায় সাতবাহন রাজ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ঋষিকনগর আক্রমণ করতে সমর্থ হয় । কিন্তু কলিঙ্গের সৈন্যবাহিনী কৃষ্ণা নদীর তীরে এবং সাতকর্ণির রাজ্যের দিকে অবস্থিত কোন নগরী আক্রমণ করেছিল এরুপ ঘটনাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে চিন্তা করা যুক্তিযুক্ত নয় । অন্ধ্রের রাজা সাতকর্ণি এবং সাতবাহন বংশের প্রথম সাতকর্ণিকে অভিন্ন ব্যক্তি বলেই মনে হয় । রাজত্বের চতুর্থবর্ষে খারবেল বিদ্যাধর নামে এক রাজার রাজধানী অধিকার করেন । ঐ একই বছরে তিনি সম্ভবত বেরার অঞলে রাষ্ট্রিক ও ভােজকদের পরাজিত করেন । রাজত্বের অষ্টমবর্ষে খারবেল বিহারের বরাবর পাহাড়ের নিকটবর্তী গােরথগিরি নামে একটি পার্বত্য দুর্গ অধিকার করেন । রাজগৃহ অথবা বর্তমান বিহারের গয়া জেলায় অবস্থিত রাজগীরও তিনি আক্রমণ করেন । তবে হাতিগুম্ফা লিপির এরুপ অর্থ করা যায় যে, তিনি গােরথগিরি নামক একজন রাজাকে হত্যা করেন ও রাজগীর লুণ্ঠন করেন । খারবেলের এই সামরিক অভিযানের সাফল্য যবন রাজার মনে এরুপ আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে , তিনি আত্নরক্ষার জন্য মথুরায় পলায়ন করেন । এই যবন রাজার নাম খারবেলের লেখা অনুযায়ী ‘দিমিত’ অথবা ‘ দমত ’ বলে পাঠ করা হলেও সম্ভবত তিনি ছিলেন পরবর্তী ইন্দো -গ্রীক , রাজবংশের পূর্ব পাঞ্জাবের শাসক ডিমিট্রিয়াস । 


রাজত্বের একাদশ বর্ষে খারবেল পিঠুর নগরী ধ্বংস করেন । সম্ভবত প্রাচীন পৃথুর এবং খারবেল - এর লেখ - ত্র উৎকীর্ণ পিঠুর অভিন্ননগরী । টলেমির রচনায় মাইলয়া অঞ্চলের রাজধানী পিতুন্দ্রনগরীর নাম পাওয়া যায় । সম্ভবত বর্তমান তামিলনাড় অঞ্চলের মসলিপত্তমের রাজার রাজধানী ছিল এই পিতুন্দ্রনগরী । পরবর্তী বছরে তিনি উত্তরা পথের রাজার রাজ্য সম্ভবত উত্তর - পশ্চিম ভারত আক্রমণ করেন এবং গঙ্গার তীরবর্তী কোন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে মগধের অধিপতিকে পরাজিত করেন । প্রাকৃত ভাষায় মগধের এই রাজার নাম বসতি মিত্র রুপে উল্লেখ করা হয় । সম্ভবত সংস্কৃত ভাষায় এই রাজার নাম বৃহৎস্বাতী মিত্র । যদিও অনেকে এই রাজাকে বৃহস্পতি মিত্র রুপে উল্লেখ করেন । অনেকে মনে করেন যে নন্দ ও মৌর্যদের আমলে কলিঙ্গ আক্রমণ ও জয়ের প্রতিশােধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে খারবেল অঙ্গ এবং মগধ লুণ্ঠন করে প্রচুর অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র স্বদেশে প্রেরণ করেন । নন্দদের আমলে কলিঙ্গ থেকে কয়েকটি জৈনমূর্তি মগধে আনয়ন করা হয়েছিল , খারবেল সেগুলাে পুনরায়
যথাস্থানে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন । ঐ একই বছরে তিনি সুদূর দক্ষিণের পান্ড্যরাজের রাজাকে পরাজিত করেন । 


শাসক হিসাবে খারবেল সবসময়ই প্রজাদের কল্যাণ সাধন করার চেষ্টা করতেন এবং এই ব্যাপারে অর্থব্যয়ে তার কোন কার্পণ্য ছিল না । তিনি সঙ্গীত বিদ্যায়ও খুব পারদর্শী ছিলেন এবং প্রায়ই আড়ম্বর পূর্ণ নৃত্যগীতি ও আনন্দানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে জনসাধারণের চিত্তবিনােদনের সুযােগ করেছিলেন । রাজধানী কলিঙ্গনগরীকেও তিনি নতুন নতুন মন্দির, তােরণ প্রভৃতির দ্বারা সুসজ্জিত করে তােলার ব্যবস্থা করেন । কিন্তু খারবেল এর জীবনের পরবর্তী ঘটনা অথবা মেঘবাহন প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের পরিণতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না । সম্ভবত খারবেল এর মৃত্যুর পরেই এই রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কলিঙ্গরাজ্য কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তা প্রতিবেশী রাজ্যগুলাের আক্রমণ ও বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হয় ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন