ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক বিভাগগুলাে কি কি ? কিভাবে তারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে প্রভাবিত করে ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক বিভাগগুলাে কি কি কিভাবে তারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে প্রভাবিত করে bharotborsher prakritik bivaggulo ki ki kivabe tara bharotborsher rajnoitik o sangskritik itihaske provabito kore questions answers


উত্তর : ভারতবর্ষের ভূ প্রকৃতি : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত ভারতবর্ষকে প্রকৃতি পাহাড় - পর্বত, সাগর উপসাগরের দ্বারা পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছে । এরূপ বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে থাকার ফলে ভারতবাসীর পক্ষে এক স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যমন্ডিত সভ্যতা গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছে । আবার দেশের অভ্যন্তরের কয়েকটি পর্বত শ্রেণী, অসংখ্য নদ - নদী, মরুভূমি প্রভৃতির দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কতকগুলাে প্রাকৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে । এজন্য সাধারণভাবে ভারতবর্ষকে আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিণ ভারত এই দুটি ভাগে ভাগ করলেও ভূ- প্রকৃতির সঠিক বিচারে একে পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত । এই পাঁচটি ভাগ হল — পর্বত্যাশ্রয়ীহিমালয় অঞল , সিন্ধু-গঙ্গা -ব্রম্মপুত্র বিধৌত সমভূমি , মধ্যভারতের মালভূমি , দাক্ষিণাত্যের মালভূমি এবং সুদূর দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলবর্তী নিম্ন সমভূমি 


( ক ) পর্বতাশ্রয়ী হিমালয় অঞল : পামীর গ্রন্থি থেকে নির্গত হয়ে হিমালয় পর্বতমালা ভারতের উত্তরদিকে অসমের উত্তর - পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ২৫০০ মাইল দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতাে দন্ডায়মান রয়েছে । হিমালয় পর্বতমালা চীন ও তিব্বত থেকে ভারতকে পৃথক করে রেখেছে । আবার ভারতের উত্তর -পশ্চিমের সুলেমান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং উত্তর - পূর্বের পাতকাই , নাগা , লুসাই ও আরাকান পর্বত শ্রেণী হিমালয়ের দুই প্রসারিত বাহুর মতাে একদিকে রাশিয়া , ইরান ও বালুচিস্তান থেকে এবং অন্যদিকে ব্রহ্লাদেশ থেকে ভারতবর্ষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । 


ভারতবর্ষের পক্ষে হিমালয় পর্বত এবং পর্বতাশ্রয়ী হিমালয় অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম । হিমালয় পর্বত ভারতবর্ষের উত্তর সীমান্তকে সুরক্ষিত করা ছাড়াও নানাদিক থেকে এই পর্বত ভারতবাসীদের সাহায্য করেছে । বিশাল সুউচ্চ এই পর্বতমালা দক্ষিণ -পূর্ব মৌসুমী বায়ুকে বাধা দিয়ে বৃষ্টিধারা বর্ষণে সাহায্য করে ভারতবর্ষকে সুজলা - সুফলা - শস্যশ্যামলা দেশে পরিণত করেছে , আবার উত্তর - পূর্ব মৌসুমী বায়ুকে বাধা দিয়ে প্রচন্ড শৈত্য প্রবাহের হাত থেকে এই দেশকে রক্ষা করেছে । হিমালয় পর্বত না থাকলে ভারত পূর্ব এশিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হত । 
 
তাছাড়া হিমালয় অঞ্চলের তুষার বিগলিত জলধারা উত্তর ভারতের নদীগুলােকে সারা বছর পূর্ণ রেখে কেবলমাত্র ভূমিকা উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করেনি , যােগযােগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেছে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের পথও পরিষ্কার করে দিয়েছে । হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল প্রচুর বনসম্পদ ও খনিজসম্পদ দান করে দেশবাসীর শক্তিবৃদ্ধি করেছে । উত্তর - পশ্চিম দিকে যে গিরিগুলাে রয়েছে ভারতের ইতিহাসের উপর তাদের প্রভাবও খুবই গভীর । এই গিরিপথগুলাে দিয়েই বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতি ভারতে প্রবেশ করে সামরিকভাবে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে ।



ধীরে ধীরে তারাই আবার এই দেশের জনগােষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে মিশ্রিত এক জাতির সৃষ্টি করেছে ।  অপরদিকে এই গিরিপথগুলাে দিয়েই বিদেশী পর্যটকগণ এই দেশে প্রবেশ করেছে । আবার এই পথেই ভারতের জ্ঞান- বিজ্ঞান ধর্মচিন্তা প্রভৃতি বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযােগ পেয়েছে । হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলেই কতজাতি তাদের বাসভূমি গড়ে তুলেছে । এই অঞ্চলের নাতিশীতােয় জলবায়ু ও কঠোর জীবনযাত্রা এই সবজাতিকে দুর্ধর্ষ ও সাহসী করে তুলেছে । উত্তর - পশ্চিম ভারতের জাতিগুলােই বিদেশী আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরােধ করে তােলার চেষ্টা করেছে । কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেও যােগাযােগের অসুবিধার জন্য বৃহৎ কোন রাষ্ট্র এই অঞ্চলে গড়ে উঠেনি । 



( খ ) সিন্ধু- গঙ্গা - ব্ৰত্মপুত্র বিধৌত সমভূমি : সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত বিশাল এই সমভূমি সিন্ধুনদের অববাহিকা থেকে আরম্ভ করে রাজপুতানার মরুপ্রান্তর,গঙ্গা, যমুনার উর্বর সমতলভূমি , ব্রহ্মদেশ এবং আসামের ব্রম্মপুত্র-অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত । এই বিশাল ভূখণ্ডের বেশি স্থানই অত্যন্ত উর্বর এবং প্রাকৃতিক নানা সম্পদে পরিপূর্ণ । সমভূমি ও নদীবহুল হওয়ার ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার যােগাযােগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত । 
 
ভারতের ইতিহাসে সিন্দু-গঙ্গা-ব্ৰত্মপুত্র বিধৌত সমভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব খুবই বেশি । এই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিই খুব উর্বর এবং খাদ্যদ্রব্য ও জীবনধারণের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে তখনকার অধিবাসীদের কঠোর সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয়নি । ফলে প্রাচীনকালেই এই অঞলে ঘন বসতি গড়ে ওঠেছিল । যােগযােগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ভাবের আদান - প্রদানের কোন অসুবিধা ছিল না । এই সমতলভূমির পশ্চিমাংশেই সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উল্লেখ হয়েছিল । এই সমতলভূমিতেই আর্যসভ্যতার প্রথম বিকাশ ঘটেছিল । প্রাচীন ভারতের প্রধান ধর্মগুলােও সাধারণত এই অঞ্চলেই প্রথম প্রচারিত হয়েছিল । এই সমতল ক্ষেতেই মাঝে মাঝে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল এবং এদের পক্ষ থেকেই ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ার চেষ্টা শুরু করেছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা এখান থেকেই প্রথম শুরু হয় । তবে  এই অঞ্চলের অধিবাসীরা স্বল্প শ্রমে জীবন করার সুযােগ পেয়েই কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি সৃষ্টি করার অখণ্ড অবসরলাভ করলেও আয়েসী ও শ্রমবিমুখ হয়ে ওঠে । 



( গ ) মধ্যভারতের মালভূমি : উত্তর ভারতের সমভূমির দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বত পর্যন্ত এবং আরাবল্লী পর্বত থেকে ছােটনাগপুর এবং বঙ্গদেশ ও ওড়িশার প্রান্ত পর্যন্ত এই মালভূমি বিস্তৃত ।  এই অঞ্চলের জমি অনুর্বর এবং লােকবসতিও যথেষ্ট কম । এই অঞ্চলের  অধিবাসীদের জীবন সংগ্রামও ছিল অত্যন্ত কঠোর । যােগাযােগ ব্যবস্থাও অনুন্নত এবং নানারূপ বিপদসঙ্কুল । ফলে প্রাকৃতিক সুরক্ষিত অঞ্চলগুলাের অধিবাসীরা নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিল । আর্যদের আক্রমণের পর ভারতের আদিম অধিবাসীরা এই অঞলে আশ্রয় গ্রহণ করে । এদের মধ্যে কোল , ভীল , মুণ্ডা, ওরাও , সাঁওতাল প্রভৃতি প্রধান কিন্তু রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র রক্ষা করার মতাে শক্তি তাদের ছিল না ফলে অনায়াসেই তারা উত্তর ভারতের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে ।



( ঘ ) দাক্ষিণাত্যের মালভূমি : বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের দক্ষিণে নীলগিরি পর্যন্ত এবং পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট পর্বতের ত্রিভূজাকৃতি অঞ্চল নিয়ে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি গঠিত । এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে নর্মদা ,তাপ্তী , গােদাবরী , কৃষ্ণা ,কাবেরী প্রভৃতি খরস্রোতা নদী প্রবাহিত হলেও জমির উর্বর্ত বৃদ্ধি পায়নি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থারও কোন উন্নতি ঘটেনি । 

বিন্ধ্য পর্বত দাক্ষিণাত্যের মালভূমিকে উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এবং উত্তর ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দক্ষিণ ভারতকে অনেকাংশে মুক্ত রাখতে সাহায্য করেছে । উত্তর ভারতের সম্রাটদের দ্বারা দাক্ষিণাত্যকে এক সাম্রাজ্যের অধীনে আনয়ন করার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে । এই পর্বত সঙ্কুল বন্ধুর মালভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবন সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত কঠোর ।  অপরদিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে তারা নিজেদের কৃষ্টি ও সভ্যতা গড়ে তুলেছিল এবং তাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল । দাক্ষিণাত্যের সমাজ , সভ্যতা ও রাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব সৃষ্টি । উত্তর ভারতের মতাে দক্ষিণ ভারতে বিদেশী জাতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেনি , ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে নিজস্ব স্বাতন্ত্র বজায় রাখা স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ।


 
( ঙ ) সুদূর দক্ষিণ সমুদ্রোপকূলবর্তী নিম্ন সমভূমি পশ্চিম ঘাট পর্বতের পশ্চিমে আরব সাগর পর্বত , পূর্বঘাট পর্বতের পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত উপকূলভাগের নিম্নস্থানগুলােই সুদূর দক্ষিণের নিম্নভূমি নামে পরিচিত । এখানকার ভূমি বেশ উর্বর। তবে কৃষি কার্য ছাড়া সামুদ্রিক ব্যবসা - বাণিজ্য ছিল এই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা । 


সুদূর দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রোপকূল অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্ম থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে এবং তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সমুদ্র ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত । স্বাভাবিকভাবেই তারা সুদক্ষ নাবিক এবং নৌ - সেনায় পরিণত হয়েছিল । দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলের বন্দর থেকেই পশ্চিমে আরব সাগরও লােহিতসাগরেও বন্দরগুলাের উদ্দেশ্যে নৌজাহাজ যাত্রা করত । দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমেই দক্ষিণ ভারতের পরিচয় ঘটে এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ভারতীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে । এমনকি দীর্ঘকাল পর্যন্ত দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে ভারতীয়গণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভােগ করতে ও সমর্থ হয়েছিল । 



উপসংহার : প্রকৃতি ভারতবর্ষকে উত্তরের পর্বত শ্রেণী এবং দক্ষিণের সমুদ্রের দ্বারা পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে প্রায় পৃথক করে রেখেছে । পৃথিবীর অন্য কোন অংশের ও জনগােষ্ঠীর সঙ্গে স্বাভাবিক যােগাযােগ না থাকার ফলে ভারতীয় সমাজ , সভ্যতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠার সুযােগ পেয়েছে । আপন প্রতিভায় গড়ে ওঠা ভারতীয় সভ্যতা তাই বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । উত্তর পশ্চিম দিকের গিরিপথগুলাে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত জাতি ভারতে প্রবেশ করেছে তারাও ভারতীয় সভ্যতা বিকাশের মূলধারাটিকে পরিবর্তিত করতে পারেনি , বরং ভারতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেছে । তবে প্রকৃতিই এই বিশাল দেশকে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে রেখেছে । যার ফলে ভারতের কোন কোন স্থানে স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠা ছাড়াও আঞ্চলিক ভাবে রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক রীতি নীতির প্রচলন ঘটেছে । এইরুপ পরিস্থিতিতেই সমগ্র ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য সাধনের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে ।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন