দীন - ই - ইলাহী সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখসহ আকবরের ধর্মীয় নীতির বিবর্তনের বিবরণ দাও ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর দীন ই ইলাহী সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখসহ আকবরের ধর্মীয় নীতির বিবর্তনের বিবরণ দাও din i ilahi somporke bisesh ullekhsoho akborer dhormiyo nitir bibortoner biborno dao


উত্তর : সম্রাট আকবর মধ্যযুগীয় ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর আসনে আসীন । তার সমগ্র রাজত্বকালের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে ঔদার্য্য ও সহনশীলতা এই শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বস্তুত তার ধর্মনীতির মূল কথা ছিল ‘সুলহ - ই- কুল’ বা ‘সবার সাথে শান্তি’ । তবে আকবরের ধর্মমত এবং সম্রাট হিসাবে তার ধর্মনীতি বরাবর একরকম সরলরেখা ধরে চলেছিল ভাবলে ভুল হবে । তার ধর্মনীতির বিবর্তনে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায় । 


প্রথম পর্বে বলা যেতে পারে , তার সিংহাসনে আরােহন থেকে ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত , যখন তিনি নিজে একজন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান ছিলেন , যদিও তিনি কখনই উগ্র ধর্মান্ধ ছিলেন না,  , কতকগুলি উপাদানে তার ধর্মীয় মানস প্রকৃতি গঠন করেছিলেন । এই সময়ে ফতেপুর সিক্রিতে ‘ইবাদৎখানা’ বা ‘উপাসনাগৃহ’ প্রতিষ্ঠা করে তিনি সকল ধর্মমতের পণ্ডিতদের ধর্মালােচনার জন্য আহ্বান জানান । বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে বিবাদ তাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় । 


আকবরের ধর্মনীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে । এই বছর ২৬ শে জুন আকবরের ফতেপুর সিক্রির মসজিদের মঞ্চে ছাব্বিশ জন পণ্ডিত ফৌজি রচিত খুৎবা পাঠ করেন । বাউনি মনে করেন , “আল্লা হু আকবর ” শব্দ উচ্চারণের দ্বারা ব্যর্থব্যঞ্জক শব্দের ব্যবহার । আকবর , যার অর্থ ‘ঈশ্বর মহান’ আকবরই ঈশ্বর । আইন -ই - আকবরীর মতে, তিনি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে ঘােষণা করেন । তিনি দেবত্ব দাবী করেননি । ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে ২ রা অক্টোবর আকবর বিখ্যাত ‘মাহজার’ এর মাধ্যমে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তিনি নিজেকে ‘ইমান’ ও ‘মুজতাহিদ’ বলে ঘােষণা করেন । স্মিথ এই দলিলটিকে ‘Infallibality De - cree’ বা ‘অভ্রান্ত কর্তৃত্বের ঘােষণা’ বলে অভিহিত করেছেন । 

   
আকবর এর ধর্মনীতির তৃতীয় পর্যায় ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘দীন -ই -ইলাহী’ঘােষণা থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত । এই সময় আকবর নানা ধর্মের সারসত্ব নিয়ে নতুন মত প্রবর্তন করেন । যদিও তিনি ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেন নি । বাউদ্দি ও জেসুইট ধর্মযাজকগণ লিখেছেন যে ,–  “শেষ বয়সে আকবর ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলেন , কিন্তু আকবর কোরানের নির্দেশ কখনই অবমাননা করেন নি ।” মূলত ‘দীন -ই -ইলাহী ’ কোনাে নতুন ধর্মমত নয় বা কোরান বিরােধী কেনাে মত নয় । 


ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী লিখেছেন – “দীন - ই -ইলাহীর দশটি নির্দেশের মধ্যে নয়টি ছিল কোরান অনুমােদিত ।” হজযাত্রীদের জন্য তিনি যেমন পৃথক জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন তেমনি মুক্ত হস্তে তাদের অর্থ সাহায্যও করতেন । বাস্তবে ভারতবর্ষে সর্বধর্মসমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য গঠন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য । যদিও তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি । 


দীন - ই- ইলাহীর চরিত্র নিয়ে মতভেদ আছে । আকবর বিদ্বেষী বাউনি কিংবা সমসাময়িক জেসুইট ধর্মযাজকদের মতবাদের উপর নির্ভর করে ডঃ ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন “ দীন-ই -ইলাহী ছিল আকবরের ব্যর্থতার পাহাড় ।” আধুনিক ঐতিহাসিক শ্রী রামশরণ শর্মা আকবরের ধর্মনীতি সাফল্য লাভ করেনি বলে মন্তব্য করেছেন । কিন্তু দীন -ই -ইলাহীর রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না । Von Noer তাই যথার্থই লিখেছেন , “আকবরে মহত্ব এর মধ্যে প্রতিফলিত ।” খ্যাতনামা ঐতিহাসিক আতাহার আলি বিশেষ করে দেখিয়েছেন যে , “ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সার্বজনীনতা অর্থাৎ ‘সুলহ -ই -কুল ’ ছিল আকবরের আদর্শ । যা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রসারিত করেছিল ।” আতাহার আলিকে অনুসরণ করে বলা যায় যে ,আকবর বিভিন্ন সুত্র থেকে চয়ন ও পরিশ্রুত করে ‘সুলহ - ই- কুল ’ এর নতুন আদর্শের এক সুসংবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসকে স্থাপন করেন । প্রায়গিক ক্ষেত্রে তাই দেখা যায়, হিন্দু,সিয়া প্রভৃতি সকলের কাছে অভিজাত শ্রেণির দরজাও উন্মােচিত । ভারতের বিচিত্র সংস্কৃতি এবং বহুবিধ ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে আকবর একটি সুসংবদ্ধ শাসক শ্রেণিকে কাছে পেতে প্রয়াসী হন । ‘দীন-ই-ইলাহী’র গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আকবরের ধর্মনীতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ঔদার্য্য যে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই । 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন