মােগল যুগের সমাজ - জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র অঙ্কন কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর মােগল যুগের সমাজ জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র অঙ্কন কর moghol juger samaje jiboner akti songkhipto chitro ankan koro


উত্তর : মােগল যুগের সমাজ জীবন সম্পর্কে জানার উৎস হল ইউরােপীয় পর্যটকদের লিখিত বিবরণী । বার্নিয়ে , পেলশার্ট , মানুচি প্রমুখরা মােগল সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর আলােকপাত করেছেন । মুসলিম ঐতিহাসিকেরা দরবারের আড়ম্বর , সম্রাটের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয় এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন । 


বৈদেশিক পর্যটকরা তাদের বিবরণে দেখিয়েছেন , মােগল সমাজ ব্যবস্থাটি ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রথার উপরে গঠিত । সাধারণ মানুষের জীবন সামন্ততান্ত্রিক কৌলিন্যের কাছে নগন্য বলেই প্রতিভাত ছিল । অভিজাতরাই ছিলেন সম্রাটের পরবর্তী স্তরে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও পরিচালনার অধিকারী । এখানে সাধারণ মানুষের কোন স্থানই ছিল না । অভিজাতদের জীবন ছিল বিলাসিতায় পূর্ণ, তাই তাদের নৈতিক মান মােটেই উন্নত ছিল না । অভিজাতদের জীবন ছিল বিলাসিতায় পূর্ণ । পানদোষ , ব্যাভিচার , অমিতাচার ছিল নিন্দনীয় ।মৃত্যুর পরে অভিজাতদের বিষয় সম্পত্তি সম্রাট বাজেয়াপ্ত করতেন । তাই অভিজাতরা জীবনকালে তাদের ঐশ্বর্যকে ব্যয় করতেন নানা ধরনের অনৈতিক অভ্যাসের মাধ্যমে । পােশাক -পরিচ্ছদ , বিলাস ও আড়ম্বরে অভিজাতরা প্রায়ই সম্রাটকে অনুকরণ করতেন । আড়ম্বর ও জাঁকজমকের প্রাধান্যে অবশেষে অভিজাতকুল নিঃস্ব হয়ে উঠেছিল । 
 

পরবর্তী স্তরে তিনটি শ্রেণিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে ; যেমন - (১ ) উচ্চবিত্ত( ২ ) মধ্যবিত্ত ( ৩ ) নিম্নবিত্ত । উচ্চবিত্তদের মধ্যে মহারাজা , জমিদার , মহাজন , উমরাহরা গণ্য হতে পারেন । এঁরা উচ্চহারে সরকারের তহবিল হতে বেতন পেতেন ; দরিদ্র মানুষদের অর্থসম্পদ বিভিন্ন উপায়ে আত্মসাৎ করে নিজ নিজ সম্পদ ভাণ্ডারকে স্ফীত করতেন । এদের শােষণ ছিল সর্বাধিক ; জাতি বা ধর্মের কোন প্রভাবে এঁরা প্রভাবিত ছিলেন না । 

উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাঝখানে ছিলেন  মধ্যবিত্তরা । বণিক , চিকিৎসক , ব্যবসায়ী , দোকানদার প্রভৃতি ছিলেন মধ্যবিত্তের স্তরে । এঁদের জীবনে আড়ম্বর ছিল না , কায়ক্লেশে এদের দিন অতিবাহিত হত । এদের আয় ছিল সীমিত । তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে এদের জীবনে নানা অসুবিধা দেখা দিত । অবশিষ্ট জনগণ ছিল নিম্নবিত্তি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত – চাকুরিজীবী মানুষ কিংবা কেরানি , সাধারণ সৈনিক প্রভৃতিরা । এঁরা কষ্টেই জীবনযাপন করতেন । একেবারে দরিদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল শ্রমিক , কৃষক , খেতমজুর প্রভৃতিরা । এদের জীবনে বঞ্চনা ও অভাবের সীমা - পরিসীমা ছিল না । আহার্য সংগ্রহের লড়াইয়েই এদের দিন কেটে যেতাে । এদের বেগার খেটে আহার সংগ্রহ করতে হত । এদের বেশিরভাগ মানুষকেই ক্রীতদাস হিসাবে গণ্য করা হত । মাটির ছােট্ট কুঁড়েঘরের মধ্যেই তারা সপরিবারে বসবাস করত । 


মােগল সমাজ ছিল পুরুষশাসিত । সমাজে কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তানদের বেশি গুরুত্ব দেওয়ার রীতি ছিল প্রচলিত । মেয়েদের অস্তিত্বের মূল্য বিশেষ ছিল না । হিন্দুসমাজ মােগল আমলে ছিল নানা কুসংস্কার প্রথাগতপূর্ণ । সতীদাহ , কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ , বহুবিবাহ , পণপ্রথা ইত্যাদি চালু ছিল ।হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা প্রবল ছিল । 

 

মুসলিম সমাজেও জাতিভেদ ছিল । বৃত্তিভিত্তিক জাতির উদ্ভব সে যুগে হয়েছিল । প্রধানত বহিরাগত মুসলমানরাই রাষ্ট্রে প্রাধান্য উপভােগ করত – এরা ইরানি , তুরানি , উজবেগীয় ও মঙ্গোলিয়া গােষ্ঠীভুক্ত ছিল । এরা হিন্দুস্থানি ও আফগানি মুসলমানদের হীন চোখে দেখতাে । বহিরাগত শ্রেণীর হাতেই ছিল দরবারী প্রতাপ - প্রতিপত্তি । তারাই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বও তথাকথিত খাঁটি মুসলমান হওয়ার দাবি করত । 


সে যুগে মুসলমানরা ধর্মগত বিভাগ থেকেও যুক্ত ছিল না । ধর্মের ভিত্তিতে তারা শিয়া , সুন্নি , খােজা প্রভৃতি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল । সুন্নি মুসলমানরাই প্রাধান্য ভােগ করত । মাঝেমধ্যে শিয়া - সুন্নি বিরােধও দেখা যেত । ভাষাগতভাবেও তাদের মধ্যে ব্যবধান ছিল । যারা উর্দুতে কথা বলত তারা দেশভাষীদের চেয়ে উত্তম ছিলেন – তাই তারা শাসকগােষ্ঠীর ভক্ত হতে পারতেন । 



তবে মােগল শাসনের প্রকৃতিগত পরিবেশ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সংহতি স্থাপনে অব্যাহত থাকে ।শাসনক্ষেত্রে সমতা ও ঐক্যবােধ জাগ্রত হয়েছিল ।এই ধারাটি আসলে সুলতানি শাসন আসলে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল , মােগলরা তা বজায় রাখতে পারে ।ভক্তিবাদের আবির্ভাব এই ঐক্যের আদর্শটি বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল । কারণ ,আকবরের শাসনকালে যে সমন্বয়ী ধারাটি দৃষ্ট হয়েছিল তার প্রভাবে মােগল সংস্কৃতি ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে প্রভেদটি মুছে গিয়েছিল । এ কারণেই মােগল শাসন ছিল ভারতীয়দের পক্ষে অনেক বেশি সহনীয় ।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন