মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকার’ ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্ণয় কর ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্ণয় কর megasthiniser indikar oitihasik gurutto nirnay koro questions answers


উত্তর : ( ১) ভূমিকা — মেগাস্থিনিস ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মৌর্যের রাজসভার গ্রীক রাষ্ট্রদূত । সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সন্ধি স্থাপিত হওয়ার পর তিনি গ্রীক রাষ্ট্রদূত হিসাবে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার প্রেরিত হন । ভারতে অবস্থানকালে তিনি এই দেশ সম্বন্ধে ভারতীয় জনসমাজ এবং মৌর্যশাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ তার ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন । মূলগ্রন্থখানি অবশ্যই পাওয়া যায় নি । কিন্তু বিভিন্ন গ্রীক ও রােমান গ্রন্থকারদের রচনায় অনেক অংশই উদ্ধৃত হয়েছিল । ম্যাকক্ৰিণ্ডল এই উদ্ধৃতি যত্ন সহকারে সংগ্রহ ও সঙ্কলন করে মেগাস্থিনিসের ইণ্ডিকা প্রকাশ করেন । এই গ্রন্থ থেকে মেগাস্থিনিসের বিবরণের অনেকাংশই জানা সম্ভব হয়েছে । 



( ২ ) মেগাস্থিনিসের বিবরণ — সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কার ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার মেগাস্থিনিসের বিবরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । তবে তিনি সম্ভবত পাটলিপুত্র নগরীর বাইরে যাননি । ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর রচনা জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে রচিত , ফলে অনেক স্থলেই তার রচনা অতিরঞ্জিত এবং বিদেশীমূলক পক্ষপাত দুষ্ট ।তাহলেও তার বিবরণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না । রাজধানী পাটলিপুত্রের একটি সুন্দর বর্ণনা মেগাস্থিনিস রেখে গিয়েছেন । পাটলিপুত্রকে তিনি ভারতের প্রধান নগরী বলে বর্ণনা করেন । এই নগরী দৈর্ঘ্য ছিল 9 ½ মাইল এবং প্রস্থে 1 ¾ মাইল । নগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৃঢ় করার জন্য গভীর পরিক্ষা ও উচ্চ প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল । নগরীর উদ্যান ও স্তম্ভরাজি সকলের বিস্ময় উদ্রেক করত । 


মেগাস্থিনিস বলেন যে পারস্য সম্রাটদের রাজ প্রাসাদ অপেক্ষাও মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রাসাদ অনেকদিক থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল । চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার ঐশ্বর্য , আড়ম্বর প্রভৃতি খুবই আকর্ষণীয় ছিল । সম্রাটের জীবনযাত্রা প্রণামী আমােদ প্রমােদ রাজকার্য পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কের মেগাস্থিনিস যথেষ্ট আলােক সম্পাত করেন । 

 
মেগাস্থিনিস তার বিবরণে তদানীন্তন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কেও বিশদভাবে আলােচনা করেন । মেগাস্থিনিসের মতে তদানীন্তন ভারতীয় সমাজ সাতটি ভাগে বিভক্ত ছিল — দার্শনিক অর্থাৎ ব্রাত্মণ ও শ্রমন , কৃষক , পশুপালক ও ব্যাধ , শিল্পকার বা ব্যবসায়ী , যােদ্ধা ও গুপ্তচর বা পরিদর্শক এবং অমাত্য । ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে বৃত্তির ওপর ভিত্তি করেই তিনি এই বিভাগ করেছিলেন । 



শাসন ব্যবস্থার উল্লেখ করতে গিয়ে মেগাস্থিনিস ‘অগ্রননাময়’ এবং ‘অস্টিননাময়’ নামক দুই শ্রেণীর রাজকর্মচারীর উল্লেখ করেছেন । রাজা অমাত্য ও সচিবগণের পরামর্শ ও সহায়তা ও পরামর্শ ক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন । মৌর্য শাসনের সামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন যে ত্রিশজন সদস্য নিয়ে একটি ‘সমর পরিষদ’ গঠিত হত । এই পরিষদের পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে এক একটি বাের্ড গঠিত হত এবং এক একটি বাের্ড বিভিন্ন সামরিক বিভাগের তত্ত্বাবধান করত । 


মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে পাটলিপুত্র নগরীর পৌর শাসনের জন্য ত্রিশজন সদস্য নিয়ে গঠিত নগর পরিষদ গঠিত হত । পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে এই পরিষদ ছয়টি সমিতি বা বাের্ডে বিভক্ত ছিল । পৌর শাসনের এক একটি দিকের ওপর এই সমিতিগুলাে তীক্ষ দৃষ্টি রাখত এবং প্রয়ােজনীয় সকল দায়িত্ব পালন করত । 


 
মেগাস্থিনিসের মতে ভারতের জনসাধারণ সরল ও আড়ম্বর জীবন যাপন করত । তাদের নৈতিক চরিত্রও ছিল খুব উন্নত । দেশে চুরি ডাকাতি ছিল না বললেই চলে । বিবাদ - বিসংবাদ নিস্পত্তির জন্য কেউ বিচারালয়ে যেতনা । আপস মীমাংসার দ্বারা তারা নিজেরাই সকল বিরােধের নিষ্পত্তি করে নিত । ধর্মানুষ্ঠান ব্যতীত কেউ মদ্যপান করত না । 



মেগাস্থিনিসের মতে ভারতীয় সমাজে সে যুগে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল না । কিন্তু অর্থশাস্ত্র এবং অনেকের শিলালিপিতে দাস প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায় । সম্ভবত মেগাস্থিনিস ভারতের দাসপ্রথা সম্বন্ধে অবস্থিত ছিলেন না । সমসাময়িক গ্রীসদেশে দাসপ্রথা যেরূপ কঠোর ছিল , ভারতের এই প্রথার সেরূপ কঠোরতা ছিলনা বলেই সম্ভবত গ্রীক গ্রন্থকার দাসপ্রথার অস্তিত্ব লক্ষ্য করতে সমর্থ হন নি । 




মেগাস্থিনিসের বিবরণ ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আলােকপাত করে । তার মতে কৃষিকার্য ও পশুপালনই ছিল জনসাধারণের প্রধান উপজীবিকা । জমির উর্বরতার প্রতি রাষ্ট্রবিশেষ দৃষ্টি রাখত । কৃষিযােগ্য জমিতে জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল । জলসেচ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল । কৃষকগণ রাজকর্মচারীদের দ্বারা কখনও উৎপীড়িত হত না । কৃষি ছাড়াও ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যও খুব উন্নত ছিল । খনিজ সম্পদের মধ্যে মেগাস্থিনিস স্বর্ণ , রৌপ্য , লৌহ , তাম্র , টিন প্রভৃতির উল্লেখ করেন । মেগাস্থিনিস মূল্যবান ধাতু ও পাথরের বহুল প্রচার ও লক্ষ্য করেন । স্বর্ণখনির খননকার্য প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস একপ্রকার পিপিলিকার নাম উল্লেখ করেন । সেই সময় ভারতের কৃষকগণ ছিল সমৃদ্ধ । খাদ্য সামগ্রীর প্রাচুর্য লক্ষ্য করে মেগাস্থিনিস মন্তব্যকরেন যে, ভারতে কখনও দুর্ভিক্ষ ঘটেনি । কিন্তু প্রাচীন সাহিত্যে ভারতের দুর্ভিক্ষের উল্লেখ পাওয়া এবং দুর্ভিক্ষের সময় শাসকদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে কৌটিল্যের বিশদ আলােচনাও দেখা যায় । 

 
মেগাস্থিনিস দণ্ডবিধির কঠোরতার কথাও উল্লেখ করেন । অপরাধের সংখ্যা কম হলেও অপরাধমূলক কাজের জন দোষী ব্যক্তিকে কঠোরশাস্তি দেওয়া হত । সামান্য অপরাধের জন্য অঙ্গচ্ছেদনের ন্যায় গুরুতর শাস্তিও দেওয়া হত । 


তবে মেগাস্থিনিসের মতে সে যুগে ভারতীয়গণ লিখতে ও পড়তে জানত না । মেগাস্থিনিসের এই মত ঠিক নয় । অশােকের লিপিগুলাে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে সাধারণ ভারতীয়রাও লিখতে ও পড়তে জানত । কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে ভারতীয়গণ লিখন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত থাকলেও বিদ্যাচর্চা ছিল খুবই সীমিত । 


উপসংহারে বলা যায় যে, মেগাস্থিনিস ছিলেন বিদেশী , ভারতের সর্বত্র তিনি ভ্রমণ করার সুযােগ পাননি । ভারতীয়দের ভাষাও তিনি জানতেন না ।অনেক স্থানে জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে তিনি তথ্য সরবরাহ করেছেন । সেজন্য অনেক ঐতিহাসিক তার বিবরণকে নির্ভরযােগ্য বলে মনে করেন না । কিন্তু বর্তমানকালে বেশিরভাগ পণ্ডিতগণ তার বিবরণী অনেকাংশ সত্য বলে মনে করেন । তাছাড়া তার অনেক বক্তব্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র দ্বারা ও সমর্থিত হয় । সুতরাং ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মেগাস্থিনিসের গুরুত্ব স্বীকার করতেই হবে ।


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন