অশােকের সাম্রাজ্যের সীমানা কিভাবে নির্ণয় করা যায় ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর অশােকের সাম্রাজ্যের সীমানা কিভাবে নির্ণয় করা যায় ashoker samrajyar simana kivabe nirnay kora jai questions answers


উত্তর : ( ১) অশােকের সাম্রাজ্যসীমা — মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশােক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরােহন করে এবং চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন । রাজত্বলাভের তের বছর পর ২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি কলিঙ্গ রাজ্য আক্রমণ ও জয় করেন । কিন্তু কলিঙ্গের যুদ্ধই ছিল তার জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং তারপর অশােক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে ধর্ম বিজয়ের পথ গ্রহণ করেন । সুতরাং মনে করা হয় যে , রাজত্বের প্রথম বারাে বছর পর্যন্ত সম্রাট অশােক তাঁর পূর্বসূরীদের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করেই রাজকার্য পরিচালনা ও যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সম্রাট অশােক উত্তরাধিকারী সূত্রে এক বিশাল সাম্রাজ্য লাভ করেছিলেন । তাঁর পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আফগানিস্তান থেকে নর্মদা নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারতের অধিপতি ছিলেন । সম্ভবত নর্মদা নদীর অপর তীরেও তার কর্তৃত্ব বিস্তৃত হয়েছিল । কারণ মহীশূরে প্রচলিত কিংবন্তী অনুসারে নন্দ সাম্রাজ্য মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । নন্দবংশের উচ্ছেদকারী মৌর্যরাজবংশও মহীশূরে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল বলে অনুমান করা যায় । মৌর্যসম্রাট বিন্দুসার নতুন কোন রাজ্য জয় না করলেও সাম্রাজ্যের কোন অংশ যে তাঁর হাত ছাড়া হয় নি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় । অশােক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে মৌর্যসাম্রাজ্যের সীমানা যে আরও বিস্তৃত করে ছিলেন তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত ।


 প্রকৃতপক্ষে অশােকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি গুলাের প্রাপ্তিস্থান এবং শিলালিপির দেওয়া তথ্য থেকে অশােকের আমলের মৌর্যসাম্রাজ্যের সীমানা কতদুর বিস্তৃত হয়েছিল তা জানতে পারা যায় । কলহন এর রাজতরঙ্গিনী এবং হিউ এন সাঙের বিবরণী থেকেও অশােকের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায় । তবে ঐতিহাসিক হুলস্ এর মতে “ অশােকের সাম্রাজ্যের সীমা তার শিলালিপিগুলির অবস্থান থেকে জানা যায় , কারণ এগুলাে তার সাম্রাজ্যের সীমান্তে স্থাপিত হয়েছিল ।” 
  
 

( ২ ) শিলালিপির প্রাপ্তিস্থান : (ক ) মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমানায় অবস্থিত কলিঙ্গের ( বর্তমান ওড়িষা ) ধৌলিতে এবং গঞ্জামের জৌগড় গ্রামে অশােকের চতুর্দশ শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে । কলিঙ্গ এবং অন্ধ্রই ছিল মৌর্যসাম্রাজ্যের পূর্বতম সীমা । এই দুটি অঞলই বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত । 

( খ ) উত্তর - পূর্বঅবস্থিত লুম্বিনী বা রুম্মিনদেই ও নিশ্লীভ স্তম্ভলিপি নেপালের তরাই অঞলে অশােকের সম্রাজ্যের উত্তর - পূর্ব সীমা নির্দেশ করে । 


( গ ) দেরাদুন -জেলার কালসী গ্রামে অশােকের চতুর্দশ শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে । এই শিলালিপিতে হিমালয় অঞ্চলে অশােকের হিমালয় অঞলের রাজ্যসীমা বলে মনে করা হয় । 

( ঘ ) বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলার মানসেরা গ্রামে এবং পেশােয়ার জেলার শাবাজারহি গ্রামে দুটি চতুর্দশ শিলালিপি পাওয়া গিয়েছিল । এই স্থান দুটিকে অশােকের সাম্রাজ্যের উত্তর -পশ্চিম সীমান্তের নির্দেশে মনে করা হয় । 


( ঙ ) গ্রীক সূত্র থেকে জানা যায় যে মৌর্যসাম্রাজ্যের সীমানা উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়িয়ে হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । সম্প্রতি আফগানিস্তানের জালালাবাদে এই গান্ধারের তক্ষশীলায় আরমাইক লিপিতে লিখিত অশােকের শিলা লেখ পাওয়া গিয়েছে । এই আবিষ্কার থেকে প্রমাণিত হয়েছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রীক সেনাপতি সেলুকাসের কাছ থেকে কাবুল , কান্দাহার হিরাট ও বালুচিস্তান জয় করেন । চন্দ্রগুপ্তের এই জয়ের ফলে মৌর্যসাম্রাজ্যের উত্তর - পশ্চিম সীমানা হিন্দুকুশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল । 


( চ ) কাথিয়াওয়াড়ের জুনাগড়ে অশােকের শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে । 
 

( ছ ) মহারাষ্ট্রের থানে জেলার সােপারা বা সুপর্ক - এ অশােকের শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে । এই শিলালিপিগুলাে থেকে জানা যায় যে পশ্চিম দিকে আরবসাগর পর্যন্ত অশােকের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল । 


( জ ) দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশের কুনুল জেলার এরাগুণ্ডিতে অশােকের একটি চতুর্দশ লিপি পাওয়া গিয়েছে । 


( ঝ ) মহীশূরের বর্তমান কর্ণাটক চিতলদ্রুগ জেলায় অশােকের তিনটি অপ্রধান শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে । এই সব নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় যে অন্ধ্রের কুনুল এবং মহীশূর ( বর্তমান কর্ণাটক ) এর চিতলদ্রুগ জেলা পর্যন্ত নিশ্চয়ই অশােকের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল । ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে অশােকের শিলালিপিগুলাে নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্রে যা বাণিজ্য কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছিল । এই লিপিগুলাের ভৌগােলিক অবস্থান প্রমাণ করে যে সাম্রাজ্য উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বত থেকে দক্ষিণে অন্ধ্র ও মহীশূর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । 



( ৩ ) অন্যান্য নিদর্শন - অশােকের শিলালিপিতে তার সাম্রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে যে তথ্য উৎকীর্ণ আছে তা থেকে এ সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা যায় । এগুলােকে ঐতিহাসিকগন অভ্যন্তরীণ প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন । দ্বিতীয়, পঞম ও ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে অশােক তার রাজ্যের সীমান্তে যেসব জাতি বাস করত তাদের কথা উল্লেখ করেন । এই জাতিগুলাে হল যােন অর্থাৎ যবন বা গ্রীক, কম্বােজ, ভােজ ,গন্ধর , নভক -নভপংক্তিগণ , রাষ্ট্রিক অন্ধ্র ও পরিন্দ । এই সব জাতির অনেকগুলােকে ঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি । যােন বা গ্রীক জাতি উত্তর - পশ্চিম সীমান্তে কান্দাহারে , কম্বােজ জাতি রজৌরি , কাবুল ও বেগ্রাম অঞ্চলে , গন্ধার জাতি তক্ষশীলায় বসবাস করত । ভােজ ও রাষ্টিক উভয়েই মহারাষ্ট্রে বসবাস করত । মহারাষ্ট্রের নাসিক ও পুনে জেলায় রাষ্ট্রিকরা বসবাস করত । থানা ও কোলবা   জেলায় ভােজরা বাস করত । তাছাড়া মধ্য প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদেও ভােজরা বাস করত । অন্ধ্ররা বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশে বাস করত । নভক - নভপংক্তি ও পরিন্দদের বাসস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন মত পােষণ করেন । ডক্টর হেমচন্দ্ররায়চৌধুরী পরিন্দদের অন্ধ্রের প্রতিবেশী ছিল বলে মনে করেন । আর নভক - নভপংক্তিরা সম্ভবত নেপাল সীমান্তে বসবাস করত । 


 
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিবেশী রাজ্যগুলাের নামও অশােকের শিলালিপিগুলােতে পাওয়া যায় । অশােক তাঁর দ্বিতীয় ও ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে ‘অন্ত’ অর্থাৎ সীমান্তের প্রতিবেশী দেশগুলাের নাম দিয়েছেন । এই বিবরণ থেকেও মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে জানা যায় । দক্ষিণদিকে তার প্রতিবেশীরা ছিল চোড় বা চোলগণ ,পাণ্ড্যগণ , সতিয়পুত্র ও কেরলপুত্র বা কেরল । এখানে লক্ষ্যণীয় যে অশােক চোল ও পাণ্ড্যদের ক্ষেত্রে বহুবচন এবং সতিয়পুত্র ও কেরল পুত্রের ক্ষেত্রে একবচন ব্যবহার করেছেন । অশােকের আমলে দুটি চোলরাজ্যের কথা জানা যায় । দক্ষিণ চোল রাজ্যের রাজধানী টলেমির মতে ছিল ওরর্থেীরা । কানিংহাম এই স্থানটিকে ত্রিচিনােপল্লীর কাছে উরাইয়ুর বলে চিহ্নিত করেন । আর উত্তর চোল রাজ্যের রাজধানী ছিল আর্কট । পাণ্ড্যদের দুটি রাজ্যেরও কথা জানা যায় । টলেমির মতে মাদুরাই , তিরুপেলভেলি ও তৎসংলগ্ন জেলা নিয়ে একটি পাণ্ড্যরাজ্য ছিল এবং সম্ভবত মহীশূরের একাংশ নিয়ে অপর একটি পাণ্ড্যরাজ্য ছিল । কানাড়া , কুর্গ, মালাবার ও মহীশূরের একাংশ নিয়ে কেরল রাজ্য গঠিত ছিল । সতিয়পুত্র ছিল উত্তর মালবার আর ত্রিবাঙ্কুরের বৃহত্তর অংশ নিয়ে গঠিত । এই অঞ্চলগুলাে বাদ দিয়ে দক্ষিণ ভারতের বাকি অংশ অশােকের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল । 


( ৪ ) বঙ্গদেশ ও কাশ্মীর সংক্রান্ত সমস্যা — বঙ্গদেশ মৌর্যসাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল কিনা এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । কারণ বঙ্গদেশে অশােকের কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি । তবে ব্রাক্ষ্মী হরফে লেখা মহাস্থানগড় শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর এবং তাম্রলিপ্ত বন্দর অশােকের স্তূপের কথা হিউ - এন -সাঙ উল্লেখ করায় স্বভাবতই বঙ্গদেশ মৌর্যসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয় । কলহনের বিবরণ অনুযায়ী কাশ্মীর মৌযসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা যায় । কলহন রাজতরঙ্গিনীতে কাশ্মীরে অশােকের ও তার বংশধর জলৌকার শাসনের কথা উল্লেখ করেন । তবে কামরূপ মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে ছিল বলে মনে হয় । 


( ৫ ) অন্যান্য নিদর্শন - অশােকের সাম্রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে অপর যে প্রমাণগুলাে পাওয়া যায় তা হলাে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা তার স্থাপত্য নিদর্শনগুলাে । এই স্থাপত্যগুলাের ভৌগােলিক অবস্থান অশােকের রাজ্যসীমার ইঙ্গিত দেয় । কিংবদন্তী অনুসারে অশােক কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরটি স্থাপন করেন । কাশ্মীরের শ্রীনগরের ও নেপালের স্থাপত্যের ঐতিহ্য থেকে অনুমান করা হয় যে এই স্থান দুটি অশােকের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল । অপরদিকে হিউ - এন -সাঙ ভারতে আসার সময় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের সময় যে সব স্থানে অশােক -নির্মিত স্তু পদেখতে পান সেগুলাে হল (ক ) কপিশ বা কাফ্রিস্তান , ( খ )নগরহার বা জালালাবাদ , (গ ) তাম্রলিপ্ত বা তমলুক ; (ঘ ) সমতট বা পূর্ববাংলা ; ( ঙ) পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ; (চ) কর্ণসুবর্ণ (দক্ষিণবঙ্গ ); (ছ ) দক্ষিণের চোল ও দ্রাবিড় দেশেও তিনি অশােক নির্মিত স্তুপ দেখেন । হিউ - এন -সাঙ - এর এই বর্ণনার সঙ্গে অশােকের শিলালিপির ভৌগােলিক অবস্থান মােটামুটি মিলে যায় । সুতরাং উত্তর - পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত থেকে দক্ষিণ পেন্নার নদী পর্যন্ত সম্রাট অশােকের সাম্রাজ্য যে বিস্তৃত ছিল না নিশ্চিতভাবে বলা যায় ।



 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন