হুন ও অন্যান্য শত্রুদের বিরুদ্ধে স্কন্দগুপ্ত কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন ?

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর হুন ও অন্যান্য শত্রুদের বিরুদ্ধে স্কন্দগুপ্ত কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন hun o ananya shotruder birudhe skondogupto ki babostha grohon korechilen questions answers


উত্তর : ( ১ ) ভূমিকা : সম্রাট কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষের দিকে শত্রুর আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বিশেষ ভাবে বিঘ্নিত হয় । কিন্তু এই শত্রুর পরিচয় সঠিক ভাবে জানা যায় না । সাধারণত পুষ্যমিত্র নামক উপজাতিকে এই শত্রু বলে মনে করা হয় । ভিটারি স্তম্ভলিপি থেকে এই আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায় । বিষ্ণুপুরাণে নর্মদা উপজাতিকে এই শত্রু বলে মনে করা হয় । ভিটারি স্তম্ভলিপি থেকে এই আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায় । বিষ্ণুপুরাণে নর্মদা নদীর উৎপত্তি স্থলের নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের পুষ্যমিত্র বলে উল্লেখ করেন । তবে পুষ্যমিত্র জাতির পরিচয় যাই হােক না কেন তারা নিঃসন্দেহে খুব শক্তিশালী ছিল । শেষ পর্যন্ত যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত দীর্ঘ এক সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পুষ্যমিত্র জাতিকে পরাজিত করে গুপ্তসাম্রাজ্যকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন । যুদ্ধ ক্ষেত্রে এই সাফল্য যুবরাজ স্কন্দগুপ্তের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে পিতা অতিক্রম করে তিনি সিংহাসনে আরােহন করেন ।


মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের শ্লোক এবং স্কন্দগুপ্তের ভিটারি লিপি থেকে জানা যায় যে কুমার গুপ্তের পর স্কন্দগুপ্তই সিংহাসনে আরােহন করেন । সেখানে আরও বলা হয়েছে যে এই সময় শত্রুগণের আক্রমণে গুপ্তকুললক্ষ্মী বিচলিত হয়ে ওঠেন । কিন্তু তার পরাক্রমে সমস্ত অরিকুল পরাজিত হয় এবং বিচলিতা কুললক্ষ্মীকে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করেন । সিংহাসনে আরােহণের পর স্কন্দগুপ্তের প্রচারিত মুদ্রায় তীরধনুক হস্তে সুসজ্জিত বীর বেশে গরুড় চিহ্নিত পতাকার নীচে দন্ডায়মান স্কন্দগুপ্তের প্রতিমূর্তির দিকে সহাস্যবদনে বামহস্তে পদ্মফুল এবং দক্ষিণহস্ত অন্য কোন বস্তুসহ এক নারীমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায় । 

( ২ ) হুন আক্রমণ : শাসনকার্যে প্রবৃত্ত হয়ে স্কন্দগুপ্ত সমস্ত প্রদেশে উপযুক্ত গােপ্তা নিযুক্ত করেন । পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তিতে চিরাত দত্ত সেই সময় উপরিক ছিলেন । মহারাজ গােবিন্দগুপ্ত পশ্চিম মালবের অর্থাৎ উজ্জয়িনীর শাসনকর্ত্তা এবং তার অধীনে রাজা প্রভাকর মান্দায়সারের সামন্তপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন । মহারাজ ঘটোৎকচগুপ্ত অথবা তার কোন বংশধর পূর্ব মালব শাসন করতেন । পর্ণদত্ত সৌরাষ্ট্রের শাসনকর্তা ছিলেন এবং চক্ৰপালিত তার সহকারী নিযুক্ত হন । কিন্তু শাসন কার্যের এইরুপ সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও স্কন্দগুপ্ত দীর্ঘকাল শান্তিতে রাজত্ব করতে পারন নি । সিংহাসনে আরােহণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হন । সমসাময়িক শিলালিপি বিরােধী রাজাদের সঙ্গে তার যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে এবং বিরােধী রাজাদের অনেককে ম্লেচ্ছ বলেও বর্ণনা করলেও তাদের সম্পর্কে বিশদ কোন বিবরণ লিপিবদ্ধ করে নি । তবে ইয়ােরােপ ও এশিয়ার সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী হুনদের বিরুদ্ধে তিনি যে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন , সুনিশ্চিত ভাবে সে কথা জানা যায় । খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মধ্য এশিয়ার নিষ্ঠুর ও হিংস্র প্রকৃতির যাযাবর হূন জাতির ইফথালিটিস অথবা শ্বেত হূন জাতি নামে পরিচিত একটি শাখা ইক্ষু নদীর উপত্যকা অধিকার করে এবং পারস্য ও ভারত এই দুই দেশের রাজনৈতিক শান্তি ভঙ্গ করার চেষ্টা করে । গান্ধার দেশজয় করে সেখানে তারা রাজ্য স্থাপন করার চেষ্টা করে এবং ভারতের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে । ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ




 করেও তারা গুপ্তসাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা স্থাপন করার চেষ্টা করে । সিংহাসনে আরােহণের পূর্বেই স্কন্দগুপ্ত শত্রুকে পরাজিত করে গুপ্তসাম্রাজ্যের অখন্ডতা বজায় রাখেন । সিংহাসনে আরােহণের পর তার অধিকতর শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হওয়া তার প্রয়ােজন হয়ে পড়ে । শিলালিপিতে হূনদের বিরুদ্ধে স্কন্দগুপ্তের যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় । শক্তিশালী হূনদের তিনি সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত করে গুপ্তসাম্রাজ্যকে নিরাপদ করে তােলেন । 
 

হূনরা এই যুদ্ধে প্রচন্ড ভাবে পরাজিত হয় বলে তাদের পক্ষে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নতুন করে ভারত আক্রমণ করা সম্ভব হয় নি । ঐতিহাসিক অ্যালান মনে করেন যে হূনদের বিরুদ্ধে স্কন্দগুপ্তের বিজয়ের কাহিনী সােমদেব রচিত কথাসরিৎসাগরে পাওয়া যায় । কথাসরিৎসাগরের বিবরণ অনুযায়ী উজ্জয়িনীর রাজা মহেন্দ্রদিত্যের পুত্র বিক্রমাদিত্য সিংহাসন আরােহণের পর আক্রমণকারী ম্লেচ্ছদের পরাজিত করেন । 
 



ডক্টর আর . কে. মুখার্জীর মতে শত্রুদের পরাজিত করেই স্কন্দগুপ্ত সন্তুষ্ট হন নি । তিনি দিগ্বিজয়েও মনােনিবেশ করেন । তবে যুদ্ধে পরাজিত রাজাদের প্রতি তিনি সদয় ব্যবহার করেন । কাথিয়াওয়াড় থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমগ্র আর্যাবর্ত স্কন্দগুপ্তের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় । পশ্চিমে সৌরাস্ট্র এবং তার সংশ্লিষ্ট গুজরাট ও মালবের বিভিন্ন অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল । জুনাগড় শিলালিপি এবং নানাস্থানের প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে ঐ অঞলে স্কন্দগুপ্তের অধিকারের কথা জানা যায় । 


( ৩ ) কৃতিত্ব : হূনদের পরাজিত করে স্কন্দগুপ্ত ভারতের রাজনৈতিক শান্তি ও অখন্ডতা রক্ষা করে তুলনাহীন কৃতিত্বের অধিকারী হন । সমসাময়িক ইয়ােরােপ ও এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে স্কন্দগুপ্তের এই কৃতিত্বের গুরুত্ব প্রকৃষ্ট ভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব । স্কন্দগুপ্তের সিংহাসনে আরােহণের কয়েকবছর পূর্বে হূনজাতি ইয়ােরােপে তাদের প্রাধান্য স্থাপন করে এবং শক্তিশালী রােম সাম্রাজ্য তাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় । স্কন্দগুপ্তের নিকট পরাজিত হওয়ার কিছুদিন পরে তারা পারস্যের রাজাকে হত্যা করে সেখানে প্রচন্ড অশান্তির সৃষ্টি করে । নরহত্যা , লুণ্ঠন, অগ্নিকান্ড ও নানা প্রকার ধ্বংসকার্য ছিল হূন আক্রমণের প্রধান বৈশিষ্ট্য । হূনদের অত্যাচারের আশঙ্কা থেকে ভারতবাসীকে রক্ষা করে তিনি এবং তার এই বীরত্বের প্রতীক হিসাবে সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অনুকরণে তিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন । 



পর্ণদত্তের গিরনার শিলালিপিতে জনপ্রিয় শাসকের অধীনস্থ একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যের পরিচয় পাওয়া যায় । বঙ্গোপসাগর থেকে আরবসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য স্কন্দগুপ্তের নেতৃত্বে তার বিশ্বস্ত অনুগত ও সুদক্ষ শাসকগণ যােগ্যতার সঙ্গে শাসন করতেন । সাম্রাজ্যের ভিত্তি খুব দৃঢ় ছিল বলেই দুধর্য হূনদের পক্ষেও স্কন্দগুপ্তের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি । কিন্তু দীর্ঘদিন ব্যাপী ব্যয়বহুল সামরিক অভিযানের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আর্থিক অবনতির সূচনা হয় । স্কন্দগুপ্তের আমলে স্বর্ণমুদ্রা নির্মাণ হ্রাস পায় এবং মুদ্রা নির্মাণের বৈচিত্র্যও লােপ পায় । স্বর্ণের বিশুদ্ধতা রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে ওঠে । আর্থিক এই সঙ্কটের মূল কারণ যে ছিল হূন আক্রমণ সে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই । তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে হূনদের পরাজিত করা সম্ভব হলেও হূন আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় । 


স্কন্দগুপ্ত পরধর্মমত সহিষু ছিলেন । তিনি ভাগবত অর্থাৎ বিষ্ণুর উপাসক হলেও অন্যের ধর্মাচরণে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না । ভিটারি স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় যে তিনি বিভিন্ন দেব দেবীর জন্য কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেন । কাহায়ু শিলালিপি থেকে জানা যায় যে তিনি  জৈন সন্ন্যাসীদের জন্য একটি মঠ নির্মাণ করেন । হিউ - এন - সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে , সক্রাদিত্য অথাৎ স্কন্দগুপ্ত নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণ করেন । তা থেকে মনে হয় যে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম ও শিক্ষাবিস্তারের পৃষ্ঠপােষকতা করেন । চীনের সঙ্গে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং ৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি চীন সম্রাটের কাছে দূত প্রেরণ করেন । সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায় যে স্কন্দগুপ্ত শুধুমাত্র বীর যােদ্ধাই ছিলেন না শাসনকার্যের প্রতিটি বিভাগে তিনি অসামান্য যােগ্যতার পরিচয় দিতে সমর্থ হন ।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন