১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল কী ?

Clg history questions answers কলেজ প্রশ্নোত্তর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল কী ১৮৫৭ khirstabder bidroher pholaphol ki


উত্তর : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ভারত ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা । স্যার লেপেল গ্রিফিন -এর মতে , এই মহাবিদ্রোহ ভারতীয় আকাশ থেকে বহু মেঘ দূরে সরিয়ে দেয় । তার মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ অপেক্ষা কোনও মঙ্গলজনক ঘটনা ইতিপূর্বে ভারত ইতিহাস সংঘটিত হয়নি । পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেন যে , যদিও এই বিদ্রোহ প্রত্যক্ষভাবে দেশের কিছু অংশকে প্রভাবিত করেছিল মাত্র , তবুও এই বিদ্রোহ সারা ভারতকে বিশেষত ব্রিটিশ প্রশাসনকে কাঁপিয়ে তুলেছিল । বলাবাহুল্য ভারত ইতিহাসে এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং ভারতীয় সমাজ , রাজনীতি , অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাব ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ । 


কোম্পানির শাসনের অবসান : ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ২ আগস্ট ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতে দীর্ঘ একশাে তিন বছরের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবলুপ্তি ঘটে এবং ভারত শাসনের দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয় । এই পরিবর্তনকে ঐতিহাসিক স্মিথ ‘মামুলি’ বলে অভিহিত করেছেন । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য যে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেটিং আইন ও অন্যান্য পরবর্তী সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির ক্ষমতা পর্যায়ক্রমে খর্ব করা হয় । এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি হল ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন । 


শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন : মহাবিদ্রোহের পর ভারতীয় রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতিগত পরিবর্তন ঘটে । ভারত -শাসন আইনের মাধ্যমে ভারত শাসনের সার্বিক দায়দায়িত্ব ভারত - সচিব -এর হাতে অর্পিত হল । ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ভারত - সচিবের পদ গ্রহণ করবেন । তিনি তার কাজকর্মের জন্য মন্ত্রিসভা ও সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন । অন্যদিকে ভারত সচিব পনেরাে জন সদস্য বিশিষ্ট একটি পর্ষদের সহযােগিতায় শাসনকার্য নির্বাহ করবেন । ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে আরও ঠিক হল যে ভারতের অভ্যন্তরে ইংল্যান্ডের রানীর প্রতিনিধিরূপে শাসন পরিচালনা করবেন গভর্নর -জেনারেল । তাই এখন গভর্নর - জেনারেল হলেন ভাইসরয় অর্থাৎ রাজ প্রতিনিধি । 
 

মহারানীর ঘােষণাপত্র : কোম্পানির কাছ থেকে রানীর হাতে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি মহারানীর ঘােষণা , পত্রের মাধ্যমে ঘােষণা করা হল । মহাবিদ্রোহের সময় বড়লাট ছিলেন ক্যানিং । তিনিই প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হলেন । ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এলাহাবাদে এক দরবারে আনুষ্ঠানিকভাবে মহারানীর ঘােষণা প্রকাশ করা হল । এই ঘােষণাপত্রে ভারতবাসীর আনুগত্য অর্জনের জন্য কয়েকটি আশ্বাসবাণী উচ্চারিত হল । 


( ১ ) স্বত্ববিলােপ নীতি বাতিল করা হল ।

( ২ ) ব্রিটিশ সরকার রাজ্যবিস্তার নীতিতে ছেদ টানলেন ।

(  ৩ ) জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল যােগাত্যসন্ন ভারতীয় সরকারি চাকুরিতে নিয়ােগের সুবিধা পাবে । 

ভারতীয় প্রজাবর্গের প্রতি এই ঘােষণাকে ভারতীয় জনগণের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলে আখ্যা দেওয়া হয় । মহারানীর ঘােষণাপত্রকে ক্যানিংহাম ‘বাস্তব পরিবর্তন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিক মাত্র’ বলেছেন কারণ পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থার মূল চরিত্রে কোনাে হেরফের হয়নি । উপরের বহিরঙ্গে পরিবর্তন ঘটল । 


সামরিক পরিবর্তন : মহাবিদ্রোহের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলােকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতে আধিপত্য সুরক্ষিত করার জন্য সামরিক ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ পরিবর্তন ঘটালেন । 

( ১ ) সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ পদগুলি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত রইল । 

( ২ ) সৈন্যদলে যাতে সহমত ও সহভ্রাতৃত্ববােধ না গড়ে উঠতে পারে সে জন্য মিশ্র সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে রেজিমেন্টগুলি বিন্যস্ত করা হয় ।
 
( ৩ ) ভারতীয় সেনাদলে রাজপুত , ছত্রি ও উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা কমিয়ে গুর্খা , পাঞ্জাবি, পাঠান ও শিখদের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি করা হল । 

( ৪ ) সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একেবারে দুর্বল করে তােলা হল । সামরিক সংস্কারের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্যমূলক মনােভাব প্রতিফলিত হয় । ভেদনীতির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে এমনভাবে সাজানাে হল যাতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সামরিক বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তি না ঘটে । সেনাবাহিনীতে ভারতীয়দের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেল । মহাবিদ্রোহের পূর্বে সেনাবাহিনীতে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল ২,৩৮,০০০ কিন্তু ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৪০,০০০ । 


মহাবিদ্রোহের সুদূরপ্রসারী ফলাফল : মহাবিদ্রোহের সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলি ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ । ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠী ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে সুদৃঢ় করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । ব্রিটিশ শাসককূল ভারতের জমিদার ও ভূস্বামী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করলেন । এছাড়া ১৮৫৭ - র পরবর্তীকালে শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রচিত হয় । চার্লস মেটকাফ তার ‘Aftermath of the Revolt’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে শাসক ইংরেজ ও শাসিত ভারতবাসীর মধ্যে ব্যবধানের মাত্রা বৃদ্ধি পেল । এছাড়া ইংরেজ  শাসকবর্গ ভারতবর্ষে তাদের আধিপত্য মজবুত করার উদ্দেস্যে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির পথে অগ্রসর হন । আর একটি উল্লেখযােগ্য বিষয় হল, মহাবিদ্রোহের পর অর্থনৈতিক শােষণের ব্যাপ্তি । 

 
 ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর একদিকে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের ওপর শাসন ও শােষণের পথ ও পন্থা গ্রহণ করেছিল , তখন অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসনের বৈষম্যমূলক চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলেন এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হলেন ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন