উত্তর : অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ - পশ্চিম ভারতে ইংরেজ শাসন সম্প্রসারিত হলে ওইসব অঞ্চলে কী ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয় । ইতিমধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটিগুলি প্রকট হয়ে উঠতে থাকলে কোম্পানির কর্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে মােহমুক্ত হয়ে নতুন কিছু করার কথা চিন্তা করছিলেন । তারই ফলশ্রুতি হল রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ।
রাওয়াতী বন্দোবস্তের সুফলগুলি হল : এই ব্যবস্থার ভালাে -মন্দ দুটি দিকই ছিল । এই বন্দোবস্তের বালাে দিকগুলি হল —
প্রথমত । সরকারের পক্ষে এই ব্যবস্থা সুবিধাজনক ছিল । সরকারের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা ও ভুল বােঝাবুঝির সম্ভাবনা হ্রাস পায় ।
দ্বিতীয়ত । নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সরকারের পক্ষে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযােগ ছিল ।
তৃতীয়ত । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মধ্যস্বত্ব ভােগী শ্রেণির উদ্ভব হয় , কিন্তু রায়তওয়ারি ব্যবস্থার মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির উদ্ভব হয় , কিন্তু রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় মধ্যসত্বভােগী শ্রেণির কোনাে অস্তিত্ব ছিল না । বরং বলা যায় যে , এই ব্যবস্থার ফলে দক্ষিভারতে গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির বিলােপ ঘটে এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে যায় ।
চতুর্থত । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার যেমন ইচ্ছেমতাে প্রজাদের জমি থেকে উচ্ছেদের সুযােগ পেত , এখানে তা ছিল না ।
পঞ্চমত : এই ব্যবস্থার ফলে দক্ষিণভারতীয় সমাজে প্রচলিত ভূমিদাস পঞ্চমত প্রথার অবসান ঘটে । অধিকারে রায়ত ছিল ছােটো জমির অধিকারী । ভূমিদাস রাখার মতাে আর্থিক ক্ষমতা তাদের ছিল না । তারা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষ করত বা প্রয়ােজনে অর্থের বিনিময়ে অস্থায়ী মজুর নিয়ােগ করত । এর ফলে ধীরে ধীরে ভূমিদাস প্রথা লুপ্ত হয়ে যায় ।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে কুফলগুলি পর্যালােচনা করা হল : এই ব্যবস্থার কুফলও কম ছিল না ।
প্রথমত । প্রথার নানা কুফল লক্ষ করেই রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়, কিন্তু কালক্রমে কৃষকরা জমিদারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথা সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয় । ড . তারাচাঁদ বলেন যে এই ব্যবস্থায় প্রজারা বহু জমিদারের পরিবর্তে এক বিরাট জমিদার বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে ।
দ্বিতীয়ত । এই ব্যবস্থায় জমিতে কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি । সরকার প্রকাশ্যেই ঘােষণা করেন যে, ভূমিরাজস্ব হিসাবে সরকার যা আদায় করেন তা খাজনা নয় — ভাড়া । এর ফলে জমির ওপর প্রজার অধিকারের দাবি নস্যাৎ হয়ে যায় ।
তৃতীয়ত । এই ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল খুবই উচু । এছাড়া কোনাে উপায়ও ছিল না , কারণ সরকারের যুদ্ধজয় ও রাজ্যবিস্তার নীতির জন্য বিপুল অর্থের প্রয়ােজন ছিল । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এলাকা থেকে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের কোনাে উপায় ছিল না । তাই বাড়তি রাজস্বের বােঝা চাপানাে হয় রায়তওয়ারি বন্দোবস্তযুক্ত ।
চতুর্থত । বন্যা খরা বা কোনাে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হানি ঘটলেও প্রজাকে তাদেরও রাজস্ব মেটাতেই হতাে । একারণে রাজস্ব মেটাবার উদ্দেশ্যে ঋণের জন্য মহাজনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না । দরিদ্র কৃষক মহাজনের হাতে তার জমিজমা সব তুলে দিয়ে ভূমিদাসে পরিণত হয় ।
পঞ্চমত । জমিদারি ব্যবস্থায় রাজস্ব বাকি পড়লে প্রজাকে উচ্ছেদের জন্য জমিদারকে আদালতে যেতে হতাে , কিন্তু রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় সরকারি আমলারাই রায়তের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত ।