রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পরিচয় দাও ।

অনাস পাস ইতিহাস honours pass general history questions answers প্রশ্নোত্তর রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পরিচয় দাও raja krishnodeb rayer amole bijaynagarer sangskritik agrogrotir porichoy dao


উত্তর : ১৫০৯ সালে বীর নরসিংহের মৃত্যুর পর তার সৎ ভ্রাতা কৃষ্ণদেব রায় বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন । তিনি কেবল এই বংশেরই রাজা ছিলেন না , অনেকেই তাকে বিজয়নগরের সমস্ত রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে করতেন । এই মূল্যায়ন অবশ্য অযৌক্তিক নয় , ব্যক্তিগত গুণাবলীর বিচারে তিনি ছিলেন অসাধারণ । সামরিক ও অসামরিক উভয় দিকেই তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয় । তার রাজত্বকালে ( ১৫০৯ - ১৫৩০ ) বিজয়নগর রাজ্যে গৌরবের শীর্ষে আরােহন করে । বহিরাগত প্রায় সকল পর্যটকই রাজা কৃষ্ণদেবের চরিত্র ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । যােদ্ধা হিসাবে তিনি ছিলেন সাহসী ও দাম্ভিক। কূটনীতিবিদ হিসাবে বিচক্ষণ , শাসক হিসাবে প্রজাদরদী , মানুষ হিসাবে ন্যায়পরায়ণ ও সংস্কৃতিমনস্ক । 


কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে বিজয়নগর রাজ্যের সাংস্কৃতিক দিকের ব্যাপক উন্নতির পথরেখা পরিলক্ষিত হয় । তার রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যের এক নবযুগের সূচনা ঘটে । কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং তেলেগু ও সংস্কৃতি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন । কবি ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপােষকতাকে তিনি রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন । 


একজন সাহিত্যসেবী হিসাবে তিনি সংস্কৃত , কানাড়ীসহ দক্ষিণ ভারতের সমস্ত ভাষায় সাহিত্য চর্চাকে উৎসাহিত করতেন । তবে তেলেগু সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে কৃষ্ণদেবের আমল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে । ডঃ সতীশচন্দ্র লিখেছেন ,“তার রাজত্বকালে তেলেগু সাহিত্য এক নব যুগের সূচনা হয় । কারণ এই সময়েই সংস্কৃত সাহিত্যের অনুকরণ না করে তেলেগু ভাষায় প্রথম স্বাধীন রচনার সূত্রপাত হয় ।”এন ভেঙ্কট রাও লিখেছেন - “প্রতি বছর বসন্ত উৎসবের সময় তার রাজসভায় দেশের বিখ্যাত কবি , সাহিত্যিক , দার্শনিকদের আমন্ত্রিত করে কৃষ্ণদেব তাদের বহুমূল্যবান উপহার দিয়ে সম্মানিত করতেন ।” দেশের আট জন প্রধান পণ্ডিত তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন । এরা অষ্টদিগগজ নামে সম্মানিত ছিলেন ।” 


কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং একাধিক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন ।তবে সেগুলির মধ্যে মাত্র দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে । এগুলি হল তেলেগু ভাষায় রচিত ভারতের রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক গ্রন্থ : ‘ অমুক্ত মাল্যদা ’এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক ‘জাহ্নবতী কল্যাণম ' ।এছাড়া তেলেগু ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অ্যাস্টিয়ান যুগ , যার সূত্রপাত হয় রাজা নরসিংহের সময়কালে , যার চরম বিকাশ ঘটে কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে এবং তাঁর সময়কালে তার সাম্রাজ্যে সমগ্র দেশের শিক্ষা ও আলােকবর্তীতার কেন্দ্রে পরিণত হয় । কৃষ্ণদেব রায় একজন মহান নির্মাতা ছিলেন । বিজয়নগরের অনতিদূরে তার মাতা নাগলম্ব - র স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি সুসজ্জিত নতুন শহর নির্মাণ করেন । এই শহর নাগলপুর নামে পরিচিত হয় । শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে নাগলপুর ও অল্পবিস্তর ভূমিকা পালন করে । এছাড়া কৃষ্ণমন্দির , হাজরা - স্বামী মন্দির , বিঠলস্বামী মন্দির প্রভৃতি তার স্থাপত্য কীর্তি ও ধর্ম ভাবনার অন্যতম নিদর্শন । 


ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা - ই ছিল কৃষ্ণদেব রায়ের অন্যতম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । তিনি নিজে ছিলেন বৈষ্ণব কিন্তু সমস্ত ধমের প্রতি তার ছিল সমান শ্রদ্ধাবােধ । তার সাম্রাজ্যে ধর্মাচরণ সম্পর্কে কোনাে বিধিনিষেধ ছিল না । বিদেশী পর্যটক এডওয়ার্ড বারবােসা কৃষ্ণদেবের ধর্মীয় উদারতা ব্যাখ্যা করে লিখেছেন “রাজা সবাইকে এতটাই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে , তার সাম্রাজ্যে যে কেউ আসতে পারতেন । এখানে থাকতে পারতেন এবং নিজ নিজ ধর্মপালন করতে পারতেন । কেউ তাকে প্রশ্ন করতাে না যে , তিনি খ্রিস্টান, ইহুদী নাকি ধর্মহীন ব্যক্তি ।” এ থেকে মনে করা হয় যে, তার রাজত্বকালে সামরিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , শিক্ষা ও সংস্কৃতির সকল দিক থেকেই উন্নতি ঘটেছিল । সব মিলিয়ে বলা যায়, কৃষ্ণদেব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শাসক । দক্ষিণ ভারতের অন্য কোনাে শাসকের মধ্যে এমন বহুমুখী প্রতিভা গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় নি । ১৫৩০ সালে কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনের পর্ব শুরু হয় ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন